ব্যারিস্টার নাজির আহমদ : কাজী হাবিবুল আউয়াল ও তার সহকর্মীরা অনেকটা ঘটা করে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্প্রতি পদত্যাগ করলেন। এখন প্রশ্ন হলো-এই পদত্যাগেই সব শেষ? তারা দায়মুক্তি পেয়ে গেলেন? তারা যে তামাশার নির্বাচনের নামে জাতির হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করলেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করলেন, ফ্যাসিবাদকে জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে বসতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করলেন তাদের বিচার হবে না? তাদেরকে ছেড়ে দিলে জাতির কাছে কী বার্তা যাবে? ভবিষ্যতে জাতির ঘাড়ে আরেক স্বৈরাচার চেপে বসলে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের মতো আরেক উদ্ভট কমিশন যে উঠে আসবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?
শুধু আউয়াল কমিশনই নয়, বরং গত তিন তিনটি নির্বাচনের ভাঁড়দের (clown) ধরা দরকার। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠা ও জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে বসার জন্য সমানভাবে দায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন, হুদা কমিশন ও আউয়াল কমিশন। রকিব উদ্দিনের চিবিয়ে চিবিয়ে কথা, নুরুল হুদার দলকানার মতো এগ্রেসিভ আচরণ আর হাবিবুল আউয়ালের ইনিয়ে-বিনিয়ে কথাগুলো এখনও চোখে বাধে। ফ্যাসিবাদী দলের সন্ত্রাসীদের দ্বারা দিনে দুপুরে আক্রান্ত জাতীয়ভাবে পরিচিত একজন ধর্মীয় ব্যক্তির কথা একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে সদ্য বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজি হাবিবুল আউয়াল বলেন ‘তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন?’ অর্থাৎ তার স্ট্যান্ডার্ডে নির্বাচন প্রচারণায় কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করলে হয়তো কিছু একটা হয়েছে বলে ধরা হবে!
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তথাকথিত সাধারণ নির্বাচন পরিচালনাকারী তিন তিনটি কমিশনের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন নুরুল হুদা কমিশনের অন্যতম নির্বাচন কমিশনার জনাব মাহবুব তালুকদার। মাহবুব তালুকদার ছিলেন সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ, বিবেক দ্বারা তাড়িত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনার। তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি নিজে একাই স্রোতের বিপরীতে থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের পাহাড়সম অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন, করে গেছেন সত্য ও ন্যায়ের সাহসী উচ্চারণ। তাকে জাতি মনে রাখবে অনন্তকাল তার সাহসী ও দৃঢ়চেতা ভূমিকার কারণে। এমন দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বকেই তো নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া দরকার।
আউয়াল, হুদা ও রকিবরা দেশ, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে গেছেন।
২ থেকে ৫ শতাংশ ভোটকে তারা ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ দেখিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছেন। ১৭-১৮ বছরের লাখো লাখো তরুণদের স্বাধীন দেশে ৩৩ থেকে ৩৫ বয়স হলো কিন্তু তারা সাধারণ নির্বাচনে তাদের একটি ভোটও দিতে পারেনি।
অথচ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে “Government of the people, by the people, for the people” (অর্থাৎ ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’)। জনগণ যদি অবাধে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে সরকার গঠন করাতে না পারে তাহলে সেই সরকারকে তারা কীভাবে বলবে তাদের, তাদের দ্বারা ও তাদের জন্য!
গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে সম্পর্ককে ভারতীয় এক মামলায় [(2002) 8 SCC 237] ভারতের উচ্চ আদালত অত্যন্ত চমৎকার করে তুলে ধরেছেন। আদালত বলেন, "Free, fair ... elections are part of the basic structure of the Constitution .…... Democracy and free and fair elections are inseparable twins. There is almost an inseverable umbilical cord joining them. The little man's ballot and not the bullet is the heart beat of democracy” (অর্থাৎ “অবাধ, সুষ্ঠু... নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ... গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অবিচ্ছেদ্য যমজ। তাদের সাথে প্রায় অবিচ্ছেদ্য নাভির সংযোগ রয়েছে। ছোট মানুষের বুলেট নয় ব্যালট গণতন্ত্রের হৃৎস্পন্দন”)।
নির্বাচন কেমন হওয়া উচিৎ তা বাংলাদেশের সংবিধানেও সুন্দর করে বলা আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”। অপরদিকে সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে বলেছে “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য লইয়া……সংসদ গঠিত হইবে…..”।
নির্বাচনের ব্যাপারে সাংবিধানিক বিধানগুলো আর বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা করার নমুনা ও বাস্তবতা দেখুন। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ ও ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত যথাক্রমে “জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ” এবং “প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে” শব্দগুলো বা টার্মগুলোর সাথে তিনটি নির্বাচনের সাথে তুলনা করুন আর মনকে প্রশ্ন করুন কোথায় সংবিধান ও সংবিধানের বাধ্যবাধকতা আর কোথায় ছিল আউয়াল, হুদা ও রকিব কমিশনের নির্বাচনের নমুনা!
সংবিধান ও উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী গণতন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক কাঠামো। অপরদিকে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭)। গণতন্ত্রের প্রাণ ও অবিচ্ছেদ্য যমজ হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন হওয়া উচিৎ ছিল প্রত্যক্ষ নির্বাচন [অনুচ্ছেদ ৬৫(২)] এবং তাতে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ আবশ্যকীয় (অনুচ্ছেদ ১১)। প্রত্যক্ষ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার পরিবর্তে আউয়াল, হুদা ও রকিব কমিশন করেছিলেন যথাক্রমে ১৫৩ টি আসনে নির্বাচনের আগেই সরকার দলীয় এমপি নির্বাচিত, নির্বাচনের আগেই আসন বণ্টন ও ভাগাভাগি এবং স্বতন্ত্রের মোড়কে নিজ নিজ দলের বিদ্রোহী এমপি পদপ্রার্থী খাড়া করানোর তামাশার নির্বাচন। এতে রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে।
আউয়াল, হুদা ও রকিব সাহেবদের এমনি এমনি ছেড়ে দিলে জাতির কাছে ভুল বার্তা যাবে। তারা জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন। সরকারের উপর দায় দিয়ে তারা পার পেতে পারেন না। তাদের পদগুলো ছিল সাংবিধানিক। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের ক্রীড়ানক হয়েছিলেন ইচ্ছাকৃতভাবে ও জ্ঞাতসারে। আইন ও সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তাদের পদত্যাগের সুযোগ ছিল। জাতির প্রতি তাদের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করা দরকার। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে ভবিষ্যতের জন্য এটি Deterrence হিসেবে কাজ করবে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার করার পাশাপাশি সংবিধান ও সংবিধান পদত্ত পন্থা ও রাষ্ট্রের মালিক তথা জনগণের অধিকারকে স্বৈরাচারী সরকারের সাথে মিশে তামাশায় পরিণত করতে ষড়যন্ত্র করার জন্য সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এটা করতে পারলে আউয়াল, হুদা ও রকিব সাহেবদের মতো মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে ভুয়া নির্বাচন করতে আসবে না। স্বৈরাচারী কোনো সরকার চাপ দিলেও শাস্তির ভয়ে পদত্যাগ করে তারা চলে যাবে। সূত্র : মানবজমিন
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার। Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
আপনার মতামত লিখুন :