শিরোনাম
◈ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা ◈ রাজধানীর শ্যামপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি রনি গ্রেফতার ◈ টাকা না পেয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকে তালা দিলেন গ্রাহকরা ◈ দেখে মনে হয় স্কুল পড়ুয়া কিশোর, বয়স ২২, করেন মাদক ব্যবসা ◈ ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে যা বললেন শিক্ষা উপদেষ্টা ◈ চার ঘণ্টা করে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকবে ৭০০ যুবক: উপদেষ্টা আসিফ (ভিডিও) ◈ ‘তোমরা রাস্তা বন্ধ করবা, আমরা কি আঙ্গুল চুষবো’ সাধারণ মানুষের আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ (ভিডিও) ◈ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার বিষয়ে যা বললেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ◈ অলিম্পিক ক্রিকেট সরে যাচ্ছে নিউ ইয়র্কে ◈ শান্তকে টেস্ট ও ওয়ানডেতে রেখে টি-টোয়েন্টিতে সোহানকে অধিনায়ক করা য়ায়: আশরাফুল

প্রকাশিত : ০২ আগস্ট, ২০২৪, ০৪:০১ সকাল
আপডেট : ২৫ অক্টোবর, ২০২৪, ০১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধকরণ ও আমাদের দায়মুক্তি

রহমান বর্ণিল

রহমান বর্ণিল: পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে বন্দিনী বাঙালি নারীদের ওপর বীভৎস যৌন নিপীড়ন চালানো হতো। দিনের পর দিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে অসহ্য হয়ে বাঙালি মেয়েরা গায়ের কাপড় খুলে গলায় পেচিয়ে আত্মহত্যা করতো। বিকৃত যৌনলালসার নিবারণে যাতে বেঘাত না ঘটে তার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারি আত্মহত্যা ঠেকাতে এরপর নারীদের বিবস্ত্র করে রাখতো যাতে আত্মহত্যার জন্য একটুকরো কাপড়ও মেয়েরা না পায়। বন্দিনী বাঙালি মেয়েরা আত্মহত্যার জন্য এরপর বেছে নিলো ভিন্ন এক পথ। তারা আত্মহনন শুরু করলো মাথার লম্বা চুল গলায় পেচিয়ে। মাথার চুল পেচিয়েও যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে তারজন্য মিলিটারি এরপর মেয়েদের মাথার চুলও ছেঁটে দিতো। পাকবাহিনীর লাগামহীন এবং বীভৎস যৌনতা নিবারণের জন্য এই বাঙালি মেয়েদের তাদের হাতে তুলে দিতো রাজাকার আলবদর বাহিনী। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ জানেন, এই রাজাকার হচ্ছে একাত্তরের ঘাতক সংগঠন জামায়াতে ইসলামের নেতাকর্মীরা আর আলবদর হচ্ছে তৎকালীন ছাত্রসংঘের সদস্যরা, যারা একাত্তর পরবর্তী ছাত্রশিবির হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা চাইতে গিয়ে কেবল চার লক্ষ বাঙালি নারীর সম্ভ্রমই পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়নি জামায়াত-শিবির এবং যুদ্ধের গোটা নয়মাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞ আর নিকৃষ্টতর গণহত্যারই শুধু সহযোগিতা করেনি সংগঠনটি, চূড়ান্ত পরাজয় বুঝতে পেরে এই সংগঠনটির প্রত্যাক্ষ সহযোগিতায় এই অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম প্রতিহিংসার প্রতিফলন। 
যাতে স্বাধীনতা পেলেও জাতি হিসেবে বাঙালি কখনোই বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য হত্যা করেছিল দেশের অগুনতি মেধাবী সন্তানকে। তাই একাত্তরের ঘাতক সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গসংগঠন শিবিরের এদেশের রাজনীতি করার অধিকার মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, গোটা একটা জাতির জন্য প্রহসন বৈ কিছু নয়। সর্বপ্রথম ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী, আর ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে আওয়াজ ওঠে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পাশাপাশি জাহানারা ইমামের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জোর দাবি তুলেছিল সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের। কিন্তু তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিংবা জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ তো দূরে থাক, উল্টো ষোলো বছর ধরে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসরত একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে ২৮ মার্চ এই সংক্রান্ত দাবির অপরাধে ক্যান্সারে আক্রান্ত শহিদ জননী জাহানারা ইমামকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের সেদিন নিরবে অশ্রুবিয়োগ ব্যতিত আর কিছুই করার ছিল না। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তান সফর করেছিল। 
গোলাম আযম তখন পাকিস্তানে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির’ কার্যক্রম চালাচ্ছিল। জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান সফর থেকে ফেরার কয়েক মাসের মাথায় গোলাম আজমকে পুনর্বাসন করেছিল বাংলাদেশে। জিয়ার শাসন থেকে শুরু হয় এদেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলাম আর শিবিরের পুনরুত্থান। জিয়াপত্নী খালেদা জিয়ার হাত ধরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াতের ১৮ আসন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। পরেরবার মন্ত্রী বানিয়ে তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত পতাকা তুলে দিয়েছিল সেই ঘাতকদের গাড়িতে, যাদের কারণেই একাত্তরে শহিদ হয়েছিল তিরিশ লক্ষ বাঙালি। এদেশের মানুষ প্রমোদ গুনলো একদিন এমন কেউ আসবে যে একাত্তরের এই ঘাতক সংগঠনটিকে এদেশের রাজনীতি থেকে চিরতরে নিষিদ্ধ করবে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলো ঠিক, কিন্তু জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়ে তারাও যেন কিছুতেই গা দিচ্ছিলো না। বরং নিজের অজান্তেই নানানভাবে পেট্রোনাইজ করছিল সংগঠনটিকে। আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাকে আওয়ামী লীগ সরকারই সাধারণ শিক্ষার সমমান দিয়েছে। অথচ কামিল পাস একটা শিক্ষার্থী হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সমান একাডেমিক জ্ঞানও রাখে না। কিন্তু এই বিদ্যা দিয়ে সে মাস্টার্স পাসের স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।
তিন চার পাতা সিলেবাস পড়ে ফাজিল পাস করছে। আলিয়ার শিক্ষার্থীরা যাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকে তার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড তাদের শিক্ষার্থীদের সামান্য লেখায় নির্বিচারে নম্বর দিয়ে দিচ্ছে। এরপর এরা কোটা পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চান্স পাচ্ছে। অথচ দিনরাত গাদাগাদা বই পড়েও অসম প্রতিযোগিতায় এদের কাছে পিছিয়ে যাচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলাফল আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ছাত্রের চেয়ে শিবির বেশি। দেশে হাজার হাজার আলিয়া মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এগুলোকে এমপিওভুক্ত করেছে, রাজস্বের আওতায় এনেছে। ৫৬০টি মডেল মসজিদ কাম ইসলামিক সংস্কৃতি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। সেখানে জামায়াতমনারা ইমাম-মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানে বসে সরকার বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থী চেতনার চর্চা হবে এটা অনুমান করা কঠিন ছিল না। সবাই বুঝলো কিন্তু সরকার সেটা বুঝলো না। এরকম অসংখ্যভাবে আওয়ামী লীগ দেশে জামায়াত-শিবির উৎপাদনের মহোৎসব চালিয়ে গেছে নিজের অজান্তেই। আয়মান সাদিকরা যে শিবিরমনা এটা তাদের অতীতের অনেক কর্মকাণ্ডের পরিষ্কার হয়েছে। অথচ সরকার আয়মান সাদিককে, তার টেন মিনিট স্কুলকে বরাবরই পেট্রোনাইজ করে গেছে।
কোটি কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। আর সরকারি সেই অনুদানের টাকায় আয়মান সাদিকরা জামাই-বৌ মিলে নির্বিঘ্নে শিবির পয়দা করে গেছে। সারা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে শিবিরের সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ রকমের বেশি। এটা আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা। গত পনেরো বছর দল ক্ষমতায় থাকার পরও এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের এতো সমর্থক বাড়ার জন্য আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত রকমের দায়ী। কারণ জামায়াত-শিবিরের বিষয়ে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে তারা। আমাদের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ফসল এই জামায়াত-শিবিরের নিষিদ্ধকরণ। আওয়ামী লীগ হয়তো এতদিন ডিপ্লোমেটিক কারণে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি। কিন্তু আমরা বরাবরই বলে এসছি, যতই ঘুরপ্যাচ কারণ থাকুক, একাত্তরের ঘাতক এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার চেয়ে সেসব কারণ কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীনই নয়, একাত্তর পরবর্তী সময়েও বহুবার জাতি দেখেছে একাত্তরের এই ঘাতক সংগঠনের নৃশংসতর চরিত্র। বিষয়টি এতোদিনে আওয়ামী লীগের বোধদয় হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আনন্দের। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ একটা মাইলফলক। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষ বীরাঙ্গনা এবং একজন শহিদ জননী জাহানারা ইমামের কাছে এবার আমাদের কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হতে যাচ্ছে। 
 লেখক : কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়