এম আমির হোসেন: [১] সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন ছিল অহিংস। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির জন্য কিছু সুযোগসন্ধানী এতে যুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে অহিংস আন্দোলনটি সহিংস হয়ে ওঠে। আমাদের ন্যায্য দাবিদাওয়াগুলো রাজনীতির চোরাবালিতে এভাবেই বিলীন হয়ে যায়।
[২] এক আন্দোলনের ঘাড়ে ভর করে আরেক আন্দোলন জমানোর চেষ্টা কখনও সৎ রাজনীতি নয়। নিরীহ যে ছাত্র ও মানুষগুলো আহত-নিহত হলো তারা বলি হয়েছে এসব অসৎ রাজনীতিবিদদের কারণে। এদের বিরুদ্ধে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন যেন মানুষের সৎ চাওয়া নিয়ে আর কখনও অপরাজনীতি না হয়।
[৩] কারাগার ভেঙ্গে কয়েদিদের বের করে নেওয়া, মেট্রোরেল, টেলিভিশন, টোলপ্লাজা, সরকারি অফিস ভাঙচুর করা এগুলো কি সাধারণ ছাত্রদের কাজ? কোনো অসৎ রাষ্ট্রবিরোধী উদ্দেশ্য ছাড়া এমন হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কোটাবিরোধী আন্দোলনটি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চক্রান্ত দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিল কেউকেউ। এ দেশে বেহাত হওয়া অনেক বিপ্লবের মতোই এ যেন আরেকটি বেহাত বিপ্লব।
[৪] জন্মভূমির ধ্বংসলীলায় যাদের বুক কাঁপে না, স্বজাতি হত্যায় যাদের আত্মদহন হয় না তারা কেমনতর মানুষ?
[৫] কী সুন্দর হাওয়া হয়ে গেল দুর্নীতি আর পাচারের ইস্যুগুলো। বরং আন্দোলনটাই হওয়া উচিত ছিল দুর্নীতি ও পাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো পক্ষই সেদিকে গেল না কিংবা যেতে দেওয়া হলো না। বিচারিক প্রক্রিয়াধীন ও সহজে পূরণযোগ্য বিষয়টিকে সামনে এনে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। কোমলমতি ও সাধারণ মানুষেরা সুযোগসন্ধানীদের দ্বারা এভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে যুগযুগ ধরে। পোকামাকড়ের জীবন মানুষ কেবল অত্যাচারীর বঞ্চনার কারণেই পায় না বরং নিজদোষেই পায়। হায়।
[৬] আমাদের জাতিগত দুর্ভাগ্য হলো কোনো দাবিদাওয়া যতই ন্যায্য হোক সহিংস না হলে কর্তৃপক্ষ দাবিগুলোকে জোরালো মনে করে না। সহজে মানতে চায় না। সহিংসতার পরে কর্তৃপক্ষ হয়তো দাবিগুলো মেনে নেয় কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ কিছু মানুষ প্রাণ হারায়, চিরতরে সুস্থতা হারায়, কেউ ক্যারিয়ার হারায়। আন্দোলনের এই চক্রটি ছাত্রজীবন থেকেই দেখে আসছি। আজও এর কোনো পরিবর্তন নেই।
[৭] নাগরিক হিসাবে সরকারের কাছে আমার চাওয়া, কেবল ছাত্র-ছাত্রীদের নয়, সমাজে বিদ্যমান সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ন্যায্য দাবিগুলো রাজপথে জানানোর আগেই পূরণ করার চেষ্টা করুণ। স্বাধীনতার অর্ধশতক বছর পরে এসেও কেন সবকিছু রাজপথেই চাইতে হবে? এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসুন। নাগরিকদের মনের ভাষা বুঝুন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে নাগরিক-মনোভাবের অগ্রীম এই বোধোদয়ই হবে সরকারের প্রকৃত স্মার্টনেস।
[৮] এ অঞ্চলে বিপ্লব শব্দটি অন্যতম অপব্যবহৃত একটি শব্দ। বিপ্লবের নামে এখানে যা হয় অধিকাংশই তা অ্যানার্কি বা নৈরাজ্য। ক্ষমতার রেজিম পরিবর্তন কিংবা রাষ্ট্রের অগ্রগতি ধ্বংস করা হয় বিপ্লবের নামে। কবি, সাহিত্যিক কিংবা বুদ্ধিজীবীদের কারণে তরুণ সমাজে বিপ্লব শব্দটি বেশ রোমান্টিক বটে। এই সুযোগ কাজে লাগায় কিছু সুযোগসন্ধানী। যারা জীবন দেয় ভোগান্তিটুকু হয় কেবল তাদের প্রিয়জনের। অনেক বিপ্লবী শেষবেলায় এসে বুঝতে পারে তারা স্রেফ ব্যবহৃত হয়েছিল। আন্দোলনের চরিত্র বিপ্লবের মতো মনে হলেও অধিকাংশ আন্দোলনই বিপ্লব নয়। একাত্তর ছাড়া এ অঞ্চলের দ্বিতীয় আর কোনো ঘটনাকে আমি পরিপূর্ণ বিপ্লব বলে মনে করি না। এমনকি বহুল আলোচিত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানও আদর্শ কোনো বিপ্লব নয়, স্রেফ রেজিম পরিবর্তন।
[৯] রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন প্রশাসন বা পেশিশক্তি দিয়ে নয়। সকল গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে অতঃপর শক্তি প্রয়োগ করুন বৃহৎ কল্যাণের স্বার্থে।
[১০] রাজনীতি মানে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়। রাজনীতি হলো শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে ক্ষমতা দখলের লড়াই। সামাজিক চাপ ছাড়া রাজনীতি কখনও সৎ পথে থাকে না। হয় আপনি রাজনীতিকে চাপবেন নতুবা রাজনীতি আপনাকে চাপবে। একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উদার, ন্যায্য ও সৎ সমাজ গড়ে তুলুন। ব্যক্তিজীবনে তা চর্চা করুন। নাগরিক হিসাবে আপনি এই দায়িত্ব পালন করলে রাষ্ট্রও সুশাসিত হতে তখন বাধ্য হবে।
[১১] ভালো রাজনীতি পুস্তকে থাকলেও বাস্তবে নেই। বেশি খারাপ রাজনীতিকে কম খারাপ রাজনীতি দিয়ে ঘায়েল করার নামই ভালো রাজনীতি। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। লেখক: চিকিৎসক
আপনার মতামত লিখুন :