অজয় দাশগুপ্ত: স্বীকার করে নিচ্ছি,আমি অন্ধ হয়ে যাইনি। আমি বধির নই। আমার দুই চোখ দুই কান ও এক নাক ঠিকমতো কাজ করছে। কাজ করছে বলেই আমি রক্তপাত দেখেছি, সন্তানদের আহাজারী শুনেছি। আমার নাকে এসে লাগেছে বিভক্তির বিষাক্ত নিঃশ্বাস। তবু আমি কথা বলিনি। লিখতে পারিনি। আমার নিঃশ্বাস পাঠাতে পারিনি প্রাণপ্রিয় স্বদেশে। কেন? কারণ আমি খুব সাধারণ পিপিলীকাসম একজন মানুষ। আমি অপেক্ষা করছিলাম সেসব মানুষদের জন্য যাঁরা জাতির বিবেক নামে পরিচিত। যাঁদের পেছনে রাষ্ট্র ও সরকার এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা লগ্ন করেছেন। আমি সবুর করে দেখছিলাম সেসব মানুষদের কাণ্ড। যাঁরা সরকারের কাছে পদক পুরস্কার চেয়ে বিফল হননি। আমি আরো দেখছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্মৃতির মালিকরা কী করেন? যাঁরা এই চেতনাকে নিজেদের জীবন বলে বলে সম্পদ আর পদের শীর্ষে আছেন তাঁরাও মুক্তিযুদ্ধের অপমানে মুখ খোলেননি।
তারপর বোঝার চেষ্টা করলাম, কেন তাঁরা চুপ? এমনও তো হতে পারে তাঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়। এমনও হতে পারে তাঁরা শোকে নীরব পাথর হয়ে গেছেন। অথবা তাঁদের কেউ থামিয়ে রেখেছে। কিন্তু দেখলাম এক দুই তিন করে করে মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। সে কোন দলের তা জানার আগেই রক্তে রঞ্জিত রাজপথ মনে করিয়ে দিচ্ছিলÑ এ দেশ আমার অচেনা। এক রাতে আমাদের সিডনির ঘর প্রকম্পিত করে স্লোগান শুনলাম আমরা রাজাকার। কষ্ট পেয়েছি, হতবাক হয়েছি, কিন্তু বিস্মিত হইনি। যে দেশে বুদ্ধিজীবীরা পদপদকের লোভে চুপ থাকেন যাঁরা রাষ্ট্র রসাতলে গেলেও গর্তের বাইরে মুখ রাখেন না, সে সমাজে মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার এক হয়ে যাবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক। এই পরিবেশ এই বৈরী মনোভাব কি গত পনের বছরে তৈরি করা হয়নি?
বলছিলাম, তাঁদের কথা। আমার সব ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে তাঁরা বিবৃতি দিলেন। দেশের জন্য মানুষের জন্য তাঁদের এই মহান অবদান দেখে আমার ভানু বন্দোপ্যাধ্যায়ের গল্প মনে পড়ে গেছে। এঁরা সম্মানিত রঙধনু সম্প্রদায়। যখন আকাশে ঝড় বৃষ্টি শেষ, যখন মেঘ সরে গিয়ে রংধনু হেসে বলে আরে আরে আর ভয় নাই। এঁরা তাঁরা, ছাত্র মরলো ছাত্রীর কান্না ফুরালো মা শোকে পাথর বাবা নিথর হলেন তখন তাঁরা বিবৃতি দিয়ে জানালেন, আমরা আছি। এখনো মরে যাইনি। এই জীবান্মৃত বুদ্ধিজীবীরা আমাদের পরম সম্পদ?
ঘটনার কথায় আসি। ওই যে বললাম, আমি অন্ধ হয়ে যাই নি তাই আমি কোনো এক দলের হয়ে কথা বলতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল এই কঠিন সময়কে সামাল দিতে একজন বা একাধিক নেতা মাঠে এসে বলবেন, বাবারা তোমরা আমাদের সন্তান। আসো আমরা কথা বলি। শান্ত হও। না তেমন কিছু ঘটলো না। ছাত্র ছাত্রীদের মনের ভাষা পড়ার মতো কোনো নেতাই নাই আমাদের দেশে। নাই একথা আমি লিখে দিতে পারি। থাকলে কেউ বলতে পারে না, এদের শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এখন প্রশ্ন করবো, জ্বী জনাব, কী যে যথেষ্ট তা প্রমাণ হয়েছে না? মাঝখান থেকে তাদের অতীত, ঐতিহ্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা গেছে জাহান্নামে। কোথাও পালিয়ে বেঁচে কোথাও কান ধরে ওঠবস করে জান বাঁচানো তাদের জন্য মানুষের মনে কোনো সমবেদনা দেখি নি। তারাও মরেছে। মরতে পাঠানো নেতাদের গায়ে আঁচড় লাগেনি কোথাও।
ওই যে বললাম কেউ নিউ জেনারেশানের মনের ভাষা বোঝেনি। আমি জেনেছি এই জেনারেশানের নাম জেনারেশান জেড প্রজন্ম। এই জেনারেশান বা প্রজন্ম আমাদের অচেনা। এরা যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। কে ঢাকা, কে কলকাতা, কে দিল্লি বা লাহোর থাকে সেটা বিবেচ্য না, বিবেচ্য ডিজিটাল দুনিয়া। যা আমাদের শেষ বয়সে এসে আমরা পেয়েছি এবং পেয়ে বুঁদ হয়ে গেছি। তাহলে এই ডিজিটাল দুনিয়া এদের মন মানসিকতায় কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা কি বলার দরকার পড়ে? এরা স্মার্ট। এরা আধুনিক। আফসোসের কথা এই, যারা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বে বলে ঠিক করেছেন তাদের কেউই এদের মনের ভাষা পড়তে পারেনি। তারপর যা হবার তাই হয়েছে ।
আবু সাঈদের রক্তের কথা বলেনি কেউ। কেউ দায় নিতে চাইলো না হত্যাকাণ্ডের। অথচ এখন সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ে পরিণত হবার কারণে সবকিছু মায়াকান্না বা কুমিরের কান্না মনে হচ্ছে মানুষের। আন্দোলন হাইজ্যাক হোক আর বেহাত হোক, এর জন্য দায়ী সরকার। সুযোগ ছিল আলাপের। সুযোগ ছিল সমঝোতার। সে রকম কিছু হলে ছাত্রদের বিপথাগামী করতে পারতো না কেউ। সে কথা সবাই জানেন। আমি ভেবেছিলাম কেউ না কেউ এর দায়িত্ব স্বীকার করবেন। বলবেন, ভুল আমাদের ছিল। যার পরিণাম যার ফলাফল ভস্মীভূত স্থাপনাগুলো। না সেটাও হলো না। প্রধানমন্ত্রীর চোখে পানি। তিনি কষ্ট পেয়েছেন। বাকিরা এখনো আগের মতো আগের ভাষায় কথা বলছেন। কেউ সাধারণ ছাত্র হত্যার দায় স্বীকার করেননি। অথচ ঘরে ঘরে রাগের আগুন জ্বলছে। কান্নার অব্যক্ত ধ্বনিতে গুমরে মরছে আকাশ।
সব রাজনীতি এক পাশে সরিয়ে একটা কথা বড় হয়ে উঠেছে, এতো ঘরণা সাধারণ মানুষের মনে কি আগে কেউ দেখেছে? কেউ কি ভেবেছিল এমন করে ধ্বসে পড়বে তাসের ঘর? এর কারণ কি শুধুই কোটা বিরোধী আন্দোলন? একজন পাগল ও বোঝে দুঃশাসন, দুর্নীতি আর অর্থ কেলেংকারী মানুষকে ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্ধ করে রেখেছিল। তারা অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় তিতিবিরক্ত। এই হামলার পেছনে ছাত্রদের ঢাল বানানো হলে সে দায় কার? কারা সাধারণের বুকের কথা বুঝতে পারেনি? স্থাপনার জন্য আমরা কাঁদছি বটে। কিন্তু একবারও ভাবছি না কোন ফাঁক গলে এত বড় ঘটনার বীজ ঢুকেছিল। এর ব্যাখ্যা আর গবেষণা করার লোকগুলো যে ব্যস্ত। তারা এখন কীভাবে বিবৃতি দেবেন সে ভাবনায় নিমজ্জিত আছেন। তাঁদের কলম-কালি নতুন স্তাবকতার জন্য তৈরি। অথচ দেশ ও দেশের বাইরে ভাবমূর্তির বারোটা বেজে গেছে। দূরে যাবার দরকার নাই।
পাশের বাংলায় যে পরিমাণ আন্দোলন আর ক্রোধ দেখেছি, তাতেই বোঝা যায় জনমত কোন দিকে। উত্তরণ কোথায়? জেনারেশান জেড এর মনের ভাষা বুঝতে হবে। উন্নয়ন কেবল ইট, কাঠ, ইমারত পুল বানানো নয়। মনের উন্নয়ন হয়নি। সংস্কৃতিকে পায়ের তলায় পিষে রাখা হয়েছে। নাই গান, নাই কবিতা, নাই নাটক। নাই মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা। থাকলে এক দেশ এক ভাড়া এক পোশাকের মানুষ একে অপরকে এভাবে মারতে পারে না। না আমি অন্ধ হয়ে যাইনি। আমি বোবাও না। আমি রক্তপাতের বিরুদ্ধে। আমি সন্তানদের লাশের ঘাতকদের বিরুদ্ধে। আমি নিরীহ ছাত্রদের পক্ষে। আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। যারা আন্দোলনের নামে দেশের ক্ষতি করেছে তাদের পক্ষে মানুষ নেই। মানুষ অন্যায় ও হত্যার বিরুদ্ধে। আমার মতো সব আমজনতা, সাধারণ মানুষ যাদের বিবেক এখনো একটু হলেও বেঁচে আছে তারা সবাই বলি, নম্রতা, বিনয় আর কথায় সাবধান হবার বিকল্প নাই। কথায় বলে, স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে রাখিবে। ছাত্র আন্দোলন সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাদের রক্ত আর মৃত্যুর বিচার হোক। শান্তির জন্য সবাই শান্ত থাকুন। দল নয়, গোষ্ঠি নয়Ñ সবার ওপরে দেশ । দেশ আমাদের, ভবিষ্যৎ তারুণ্যের আর একফোঁটা রক্ত ও নয়, নয় মিথ্যা, নয় নাটকীয়তা। শান্তি হোক পরম পাওয়া। লেখক: কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :