স্বকৃত নোমান: এই যে আমরা ঝগড়াঝাটি করি, মারামারি-হানাহানি করি এবং ফেসবুকে বড় বড় পোস্টবাজি করি সমাজের এলিট শ্রেণি এসবের খবরও রাখে না। তারা আমাদের এসব দেশপ্রেম, মানবতা, মানবাধিকার এবং এসব কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, লেখালেখি এবং এসব রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, লালন, মরমী, সাঁইজি দেখে হাসে। বলে, আহা রে বোকার দল। তাদের কাছে দেশপ্রেম, ধর্ম, সাহিত্য কিংবা রাজনীতি অর্থহীন। তারা নিজেদের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। তারা ভোগ আর বিলাসে মত্ত।
মজুর শ্রেণিও তাই। যারা কৃষক শ্রমিক। তাদের কাছেও এসব অর্থহীন। সকালে দু-মুঠো খেয়ে তারা কাজে ছোটে। রাতে পেট ভরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের, অর্থাৎ মধ্যবিত্তদের, অর্থাৎ দুই শ্রেণির মাঝখানে চিপায় পড়াদের, এসব কীর্তিকাণ্ড তারা মাঝেমধ্যে একটু উঁকিঝুকি মেরে দেখার চেষ্টা করে। মজা পায় না। মাঝেমধ্যে পায়। একটু বিনোদিত হয়, মাঝেমধ্যে একটু মন খারাপও হয়। এর বেশি কিছু না। সিরাজুদ্দৌলার পতন হয়ে গেলো, নাকি মীর জাফর ক্ষমতা নিয়ে নিলো, মুরাকামির উপন্যাস বেশি বিক্রি হচ্ছে, নাকি পামুকের এ নিয়ে তাদের বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তারাও নিজেদের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত।
আমরা সাদা চোখে যে রাজনৈতিক সত্যকে দেখি, তা সত্য নয়। সত্যের ছায়াও নয়। ছায়ার ছায়া মাত্র। সত্য থাকে আরো গভীরে। অনেক অনেক গভীরে। আমরা তার তল খুঁজে পাই না। কখনোই পাব না। কারণ রাজনীতি হচ্ছে বিজ্ঞান। যাকে বলে পলিটিক্যাল সায়েন্স। আমার মতো তিনবেলা ভাত নালায়েকের পক্ষে এই সায়েন্স বোঝা অসম্ভব। আমরা আসলে রাজনীতির দাবার গুটি। আমরা যে গুটি, এই সত্যটিও আমরা বুঝতে পারি না। কত বড় নালায়েক আমরা। কী দুর্ভাগ্য আমাদের।
রাজার ধর্ম আলাদা। জাত আলাদা। এ কারণেই প্রাচীনকালে রাজাকে বলা হতো ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ঈশ্বরের মতোই তার কর্মকাণ্ড গুপ্ত। প্রজারা জানে না। যারা রাজার নীতিকে, অর্থাৎ রাজনীতিকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে, তাদের কেউ কেউ নীরব হয়ে যায়। অর্থাৎ চুপ মেরে যায়। আমাদের এসব দেশপ্রেম, এসব লেখালেখি এবং এইসব মারামারি-হানাহানি দেখে তারা দূরে বসে হাসে। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আছেন, যারা তাদের বুঝটাকে সাহিত্যে ধারণ করেন। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে কিংবা নাটকে। করেন আমাদের মতো বেকুবদের জন্য। কিন্তু ট্রাজেডি হচ্ছে, এসব সাহিত্য-টাহিত্য পড়ে কারো কারো বুদ্ধির মুক্তি ঘটলেও অধিকাংশেরই বিশেষ কোনো উপকার হয় না। আমরা যে বেকুব সেই বেকুবই থেকে যাই, যে গুটি সেই গুটিই থেকে যাই। বারবার হারা সত্ত্বেও আমরা বারবার গুটি হিসেবেই ব্যবহার হতে থাকি।
এক সাবেক লে. কর্নেল, যিনি বিশিষ্ট ফ্রিডম ফাইটারও, যাঁকে সবাই এক নামে চেনে, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আমাদের ভবিষ্যৎ কী? তিনি এক কথায় উত্তর দিলেন, এভাবেই, এই গেরিলা কায়দায় বেঁচে থাকতে হবে। এটাই ভবিষ্যৎ। উপসংহার আমি নিজেই এক বিশিষ্ট নালায়েক। এক নির্বোধ দাবার গুটি। নইলে এত বড় পোস্ট লিখি?Ñশত জ্যোৎস্নার মাধুরী। লেখক: কথাসাহিত্যিক। ২৮.০৭.২০২৪
আপনার মতামত লিখুন :