মোজাফ্ফর হোসেন: রাজনীতির মাঠে যেকোনো মৃত্যুতেই পরস্পরবিরোধী সবগুলো রাজনীতি একসঙ্গে জয়ী হয়। রক্তে-লাশে-স্বজন হারানো পরিবারের হাহাকারে পুষ্ট হন সর্বদলীয় নেতারা। আমরা যারা নিজেদের প্রান্তিক মানুষ মনে করি, রাজনীতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সবসময় অবিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার। আমি নৈরাশ্যবাদী মানুষ, নিজের ভিতরেই সব সময় খুন হতে হতে বেঁচে থাকা আমার। আমার বেঁচে থাকার মধ্যে আর কোনো স্বপ্ন নেই, দ্রোহ নেই, আন্দোলন নেই; শুধু দায়িত্ব আছে, দায়িত্ব আমার সন্তানের প্রতি। তারা নিজে থেকে পৃথিবীতে আসেনি, আমার বেঁচে থাকার সমস্ত দায় সেখানেই।
কোনো একদিন অকস্মাৎ রাজনীতির গুলি, কিংবা রাষ্ট্রীয় অপব্যবস্থা, অব্যবস্থার দৈব ঘটনায় সন্তানদের হত্যার মধ্য দিয়ে সেই দায় থেকে আমি মুক্তি পেতে পারি, প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ পাচ্ছে; আবার নাও পেতে পারি, আমার সন্তানরা বেঁচে থাকতে পারে। যেহেতু বেঁচে থাকতে পারে, আমাকেও বেঁচে থাকতে হবে। এই বেঁচে থাকার মধ্যে আমার কোনো আশাবাদ না থাকলেও কোনো গ্লানি নেই। গ্লানি নেই এই কারণে যে কোনোদিন ক্ষমতা আমার হাতকে, আমার হৃদয়কে রক্তাক্ত করতে পারবে না। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যার সঙ্গে ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই। ক্ষমতার নির্বিচার চাটুকারিতা করে বেঁচে থাকার মতো দুর্ভাগাও আমি না। যা অন্তর থেকে যথার্থ মনে হবে না, সেটার অন্যায় পক্ষপাতে আমি কোনোদিনই একটা শব্দও উচ্চারণ করবো না। আগেও করিনি, ভবিষ্যতেও না। ভুল করতে পারি জাজমেন্টে, কিন্তু সচেতনভাবে জাজমেন্ট বদলাতে পারব না। বেঁচে থাকার এই একান্ত অহংকারটুকু একজন নৈরাশ্যবাদী এই মানুষের আছে।
আমি কি রাজনীতিবিমুখ? না। আমি সেই রাজনীতির পক্ষে যেখানে বিরোধীদলের নয়, নিজের দলেরই (আত্মসমালোচনা) করার জন্য পুরস্কৃত করা হয়; যেখানে ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আরো দশটা ভুল নয়, ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় জনগণের কাছে; যেখানে ক্ষমতা টিকে থাকে এবং ক্ষমতার পতনও ঘটে মানবিক সিদ্ধান্ত, ন্যায় আর নীতিবোধের উপর ভিত্তি করে; সেই রাজনীতি এ দেশে কেনো এই পৃথিবীতেই কখনোই ছিল না, আগামীতেও থাকবে না। এই কারণে আমি আর সমাজবদলের স্বপ্ন দেখতে চাই না। তবে কি আমি স্কেপিস্ট? না, আমার ব্যক্তিগত সংগ্রাম হলো ক্ষমতার প্রবঞ্চনা আর মিথ্যাচারের তোষণকারী না হওয়া।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :