শামীম আহমেদ: আমরা যখন নব্বই দশকের শেষে ম্যাট্রিক, ইন্টার পরীক্ষা দিই, তখন ঢাকা বোর্ডে সায়েন্স, আর্টস, কমার্সের স্ট্যান্ড করা ৯০-১০০ জনকে মেধাবী বলা হতো। অল্পের জন্য স্ট্যান্ড করে নাই এমন আরও কিছু শিক্ষার্থী মেধাবী হিসেবে পরিচিতি পেত। স্টার মার্কস পাওয়াদের সবাই জানত ভালো ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে। দেশের সব বোর্ডের সব বিভাগ মিলিয়ে এই মেধার পরিমাণ হাজারের বেশি ছাড়াতো না। ম্যাট্রিকের পর মেধা নির্ধারণের আরেকটি নির্ণায়ক ছিলÑ কে কোন কলেজে চান্স পেলো। নটরডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, ভিকারুন্নিসা আর হলিক্রসে চান্স পেলে তারা মেধাবী। ইন্টারের পর যারা ঢাকা ইউনিভার্সিটির নানা বিভাগের শীর্ষ বিষয়গুলোতে, বা ঢাকা-সলিমুল্লাহ-চিটাগং-ময়মনসিংহ মেডিকেল আর বুয়েটে চান্স পেতো তারাও মেধাবী শিক্ষার্থী। এর বাইরে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ংঢ়ড়ৎধফরপ কয়েকজন তাদের ইন্ডিভিজুয়াল স্কিল দিয়ে মেধাবীর তকমা পেত।
আমরা পাস-টাস করে বের হয়ে যাবার পর জিপিএ শুরু হলো। প্রথমে শ’খানেক জিপিএ ৫ পেতো, তারা মেধাবী। ৪-৫ বছর যেতে যেতে এই জিপিএ ৫ পাওয়া শুরু করল লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। সবাই তাদেরও মেধাবী বলে। এই জিপিএ ৫ পাওয়া লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী দেখা যায় ভালো কোনো কলেজে চান্স পায় না-বোরহানউদ্দিন কলেজ কিংবা চর ফ্যাশন কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে পড়েও মেধাবী। এরপর শুরু হলো পাস করলেই মেধাবী। যারা পরীক্ষা দেয়, সবাই মেধাবী। এই লক্ষ লক্ষ মানুষ মেধাবী-এই ন্যারেটিভের সাথে একমত না হলেই তারা অহংকারী। এখন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নতুন করে মেধাবীর সংজ্ঞা নিধারণ শুরু হয়েছে। যারা আন্দোলনের পক্ষে তারা সবাই আন্দোলনকারীদের মেধাবী বলছে। দেশে লাখ লাখ মেধাবী। রাস্তায় লাখ লাখ মেধাবী-অথচ দুর্নীতির শেষ নাই। নিয়ম নাই। আইন নাই। আবার যারা কোটা বিরোধী তারা বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এত লাখ লাখ শিক্ষার্থীরা কীসের মেধাবী? এত মানুষ একসাথে মেধাবী হতে পারে নাকি? দেশ দুইভাগে বিভক্ত।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই যে মেধা-অমেধার ন্যারেটিভ এটা খুব দুঃখজনক। নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী মেধার সংজ্ঞা তো পাল্টাতে পারে না। নিজের পক্ষে গেলে মেধাবী, বিপক্ষে গেলে মেধাবী নয়-এটা কেমন দ্বিচারিতা? কিছু স্বার্থান্বেষী মহল মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে মুখোমুখি করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে আন্দোলনকারীরা নাকি বলছে মুক্তিযুদ্ধের কোটাধারীরা মেধাবী নয়। আমি জানি না আন্দোলনকারীরা এটা আদৌ বলেছে কিনা। যে পরীক্ষার্থী ৩ লক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিযোগিতা করে ৯০ ভাগ নম্বর নিয়ে কোন পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, আর যে ৫৫ ভাগ নম্বর পেয়ে কোটায় নির্বাচিত হয়-তাদের মেধা তো সমান নয়। মুক্তিযুদ্ধের নাতি, রাজাকারের নাতি, ব্যবসায়ীর নাতি, জেলের নাতি, রিকশাওয়ালার নাতি যে কেউ পরীক্ষায় ৯০ পেতে পারে। আবার যে কারও সন্তান ৫৫ ও পেতে পারে। এখন আপনার এজেন্ডার সাথে না মিললেই দেশের মুক্তিযুদ্ধকে জড়িয়ে বিতর্কিত ন্যারেটিভ দাঁড় করানো কেবল দুরভিসন্ধিরই পরিচায়ক।
বিষয়টি হচ্ছে বান্দরবান, খাগড়াছড়ির গহীন জঙ্গলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাস্তুভিটা হারা আদিবাসী ছেলে বা মেয়েটি মেধাবী হলেও সুযোগের অভাবে পরীক্ষায় অন্যদের মতো ভাল করতে পারবে না। ভীষণ মেধাবী হলেও প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ একজন শিক্ষার্থীর মতো প্রস্তুতি নিতে পারবে না। অনেক মেধা থাকা সত্বেও সামাজিক কূপমন্ডূকতার কারণে অনেক নারী হাজারো বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে অন্যদের মতো সমান প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস পর্যন্ত যেতে পারে না। ফলশ্রুতিতে একটি দক্ষ প্রশাসন তৈরী ও ন্যায্যতা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আদিবাসী, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কোটা দরকার। এখানে যারা কোটা পাবে, আর যারা পাবে না তারা মেধাবী নাকি অমেধাবী-এই বিতর্ক উস্কে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা অনৈতিক এবং দুঃখজনক। ১৪ জুলাই ২০২৪। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :