মুশফিক ওয়াদুদ: বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের মধ্যে পীর বিরোধী একটি প্রচারণা আছে। এটা বেশিরভাগ সময়ই সমস্যার। এটা ঠিক কিছু পীর কোরআন সুন্নাহের নির্দেশনা মতো চলেন না। কিন্তু অল্প কয়েকজনের জন্য পীরদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে খারিজ করে দেয়া বাজে একটি প্রবণতা। এদের বেশির ভাগই ইতিহাস পড়েন না। মানে এদের অনেকের দাদা-পৌদাদারা হয়তো মুসলমান হবারই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতেন না এ অঞ্চলে পীরদের ভূমিকা না থাকলে। এখন প্রভাব কমে আসলেও এখনও বহু হকপন্থী পীরদের বেশ ভালো কাজ আছে। বিশেষভাবে ফুরফুরা আর ফুলতলী পীরের কথা বলবো। আমি ছোট থাকতে পাড়ায় মহল্লায় ফুরফুরার পীর কে ওয়াজ করতে দেখতাম। রাত জেগে তাঁর ওয়াজ শোনার সেই স্মৃতি এখনও মনে পড়ে। আমার ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা তাঁর কাছ থেকেই। উম্মাহর ভালো খেদমত করেছেন।
আর ফুলতলীর পীর সিলেট অঞ্চলে কোরআন শিক্ষায় যে ভূমিকার রেখেছেন অনেক ইসলামী রাজনৈতিক দল সেটা পারে নাই। এখানে ইসলামের প্রচার পীরদের মাধ্যমেই হয়েছে। তাছাড়াও পীররা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। আমাদের এখানে বহু সময় ধরে পীররা বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ধর্মীয় কারণ ছাড়াও এ জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হয়তো পীরদের কৃষি কাজে ভূমিকা রাখা। ইতিহাসবীদ রিচার্ড ইটন তাঁর ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ বইতে এ বিষয়ে একটি চ্যাপ্টার লিখেছেন। সেই সময়ের পর্যটক দের বর্ণনায়ও এর ধারণা পাওয়া যায়। পীর রা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে জনগণকে শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে কৃষি প্রযুক্তিরও প্রশিক্ষণ দিতেন। যেমন, বর্তমানে যে মেহেরপুর জেলা তা মুঘল আমলের আগ পর্যন্ত পুরোটাই জঙ্গল ছিল। মুঘলদের বাংলা শাসনের প্রথম দিকে মেহের আলী নামে এক পীর তাঁর বোন এবং অন্য একজন সহযোগী নিয়ে ভারত থেকে এখানে আসেন। স্থানীয়দের সাহায্য নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করেন এবং কৃষি কাজে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করেন। পরে তাঁর নামেই এ জেলার নামকরণ হয়।
শাহ সাইয়িদ নাসির আল দীন মুঘল শাসন আমলের প্রথম দিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে হবিগঞ্জে আসেন। সে সময় পুরো হবিগঞ্জ জঙ্গল ছিল। সাইয়িদ নাসির স্থানীয় জনগণকে নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করেন। পরে সবাইকে নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করেন। একইভাবে খুলনা এবং বর্তমান পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলায় জিন্দাহ গাজী এবং মুবারা গাজী নামে দুই পীর সুন্দরবনের কিছু অংশ পরিষ্কার করে কৃষি ক্ষেতে পরিণত করেন। বাগেরহাটে খান জাহান আলীরও একই ভূমিকা ছিল। নোয়াখালী অঞ্চলে উমর শাহ নামে এক পীর ইরান থেকে আসেন। সে সময় নোয়াখালী জঙ্গল ছিল। তিনি মুরিদদের নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করেন এবং কৃষি কাজ শুরু করেন। প্রভাবশালী দুজন পীর শাহ জালাল এবং শেখ জালালউদ্দিন তাবরিজিরও বাংলায় কৃষি সম্প্রসারণে ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যায়। এর ফলাফল হচ্ছে বাংলাতে এতটাই চালের উৎপাদন হতো যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালাক্কা, সূমাত্রা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বহু জায়গায় চালের প্রধান রপ্তানিকারক ছিল বাংলা। ১৬০৭ সালে বৃটিশ পর্যটক এবং বণিক জধষঢ়য ঋরঃপয বাংলা সফর করে লিখেছিলেন চট্রগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন চাল বোঝাই অসংখ্য জাহাজ ভারতে এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেত। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :