তসলিমা নাসরিন: কলকাতার হিন্দুদের মধ্যে অনেকে খুব বিফ খেতে আগ্রহী। বিশেষ করে তারা, যারা জানে যে পৃথিবীর উন্নত এবং সভ্য দেশগুলোয় বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় গরুর মাংসকে সকল মাংসের সেরা মাংস বলে বিচার করা হয়। অনেকে আবার হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ বলেই গরুর মাংস খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। কেউ কেউ আবার সব সংস্কারের ঊর্ধ্বে ওঠে বিফ-খাওয়া-প্রগতিশীল-হিন্দুদের খাতায় নাম লেখাতে চায় বলে বিফ খেতে চায়। কলকাতায় আমি যখন প্রায়ই যেতাম, আশির দশকের শেষে এবং নব্বই দশকের শুরুতে, আমার সঙ্গে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বেশ সখ্য ছিল। তিনি একবার আমাকে খুব অনুরোধ করলেন, বাংলাদেশ থেকে তাঁর জন্য যেন অন্য কিছু নয়, বিফ নিয়ে আসি। বিফ খাওয়ার জন্য তাঁর প্রাণ আকুলি বিকুলি করছে, আমিই একমাত্র তাঁর স্বপ্ন পুরণ করতে পারি।
তো, পরের ভিজিটে আমি কিছু বিফ নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি যে কী ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। বউ বাচ্চাদের নিয়ে বিরাট উৎসব করে খেয়েছিলেন সেই বিফ। বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি বিফের ভক্ত একেবারেই ছিলাম না। আমি ভালোবাসতাম খাসির মাংস আর কান্ট্রি চিকেন। কলকাতায় যখন পাকাপাকিভাবে বাস করি, আমার এক কবি বন্ধু, যে হিন্দু, বিফ খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেল। আমার বাড়িতে বিফ এনে সে রান্না করে খেতে চায়। আমি বলে দিলাম, ওটি হচ্ছে না বাপু। আমি নিজে বিফ পছন্দ করি না, তার ওপর আমার বাড়ির কাজে যে মেয়েটি সাহায্য করে সে হিন্দু। আমি অনাগ্রহ প্রকাশ করার পরও সেই কবি একদিন বিফ নিয়ে হাজির এবং সে রান্না করলো তার কাক্সিক্ষত বিফ কারি। সে একাই খেল। আমি বাসন পত্র মেজে ধুয়ে রাখলাম। বাড়ির সহকারী মেয়েটিকে রান্নাঘরের ধারে কাছে আসতে দিইনি।
এ দুটো ঘটনার উল্লেখ করলাম এইজন্য যে সুদীপা চট্টোপাধ্যায় নামের এক সেলিব্রিটি শেফ বাংলাদেশের এক চ্যানেলে ঈদের এক রান্নার অনুষ্ঠানে ছিলেন, যেখানে গরুর মাংস রান্না হচ্ছিল। সুদীপা গরুর মাংসের কোফতা রান্নাও করেননি, খানওনি। কিন্তু কলকাতায় ফেরার পর তিনি হুমকি পাচ্ছেন, তাঁকে নাকি মেরে ফেলা হবে, তাঁর ছেলেকে অপহরণ করা হবে। তিনি ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। যে মানুষটি বিফ খাওয়ার পক্ষে কোনও কথা বলেননি, বিফ খাননি, তাঁকে ভুগতে হচ্ছে। যে উগ্রবাদীরা তাঁকে ভোগাচ্ছে, তারা কেন সেইসব হিন্দু বিফখোরকে হুমকি দেয় না, যারা কলকাতা শহরে প্রকাশ্যে গরুর মাংস খেয়ে অসাম্প্রদায়িক হতে চেয়েছিল? তারা ক্ষমতাবান বলে? তাহলে হুমকি শুধু ক্ষমতাহীনদের বিরুদ্ধে, নারীর বিরুদ্ধে, অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে?
ভারতের বিখ্যাত এবং ক্ষমতাবান হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান অনেকেই ভালোবেসে বিফ খান। কিন্তু উগ্রবাদীরা তাঁদের টিকির নাগাল পায় না, কিন্তু মেরে ফেলে রাস্তাঘাটের আর বাসট্রেনের সাধারণ মানুষকে, অসহায় দরিদ্র লোককে, মহারাষ্ট্রের আফাম আবদুল আনসারি আর নাসির হুসেনকে, উত্তর প্রদেশের মোহাম্মদ আখলাককে, বিহারের নাসিম কুরেইশিকে, হরিয়ানা-রাজস্থানের জুনাইদ আর নাসিরকে। খাদ্যে ধর্ম থাকে না, ধর্ম থাকে মনে। ভাল মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বাস করার ধর্ম এক, স্বর্গে যাওয়ার বা জান্নাতে যাওয়ার ধর্ম আরেক। স্বর্গে বা জান্নাতে যাওয়ার স্বার্থে যে ধর্ম, সেই ধর্ম মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করতে দ্বিধা করে না। এই ভায়োলেন্ট ধর্মটিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। শূকরের মাংস খাওয়া নিষেধ ইহুদিদের, মুসলমানদের আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সেভেন্থ ডে এডভেন্টিস্টদের, তাই বলে তারা খাচ্ছে না শূকর? দিব্যি খাচ্ছে। প্রগতিশীলরা খাচ্ছে। যে সম্প্রদায়ে প্রগতিশীলের সংখ্যা বেশি, সে সম্প্রদায়ে খাবারকে হারাম হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা কম।
আমি মনে করি সব খাবারই হালাল। যার যা খেতে ইচ্ছে করে, সে সেটা খাবে। কোনও ধর্মের নামে কারও স্বাধীনতাকে আক্রমণ করা হলে, সেই ধর্মের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মায়। কারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদÑস্বাধীনতা। উগ্রবাদীরা প্রতিটি ধর্মকেই মনস্টার বানিয়ে ফেলছে। উগ্রবাদীদের হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত। ৬ জুলাই ২০২৪।
যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/হধংৎববহ.ঃধংষরসধ
আপনার মতামত লিখুন :