মাহবুবুর রহমান, ডেনমার্ক: দেশের মানুষ এখন আর ঘুষ খোরদের ঘৃণার চোখে দেখে না। চারিদিকে সরকারি কর্মকর্তা,রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তারা সম্মিলিতভাবে দেশের অর্থ আত্মসাতের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। চোরের সঙ্গে চোরদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এক চোর বিপদে পড়লে অন্য চোর এগিয়ে আসে ও নানান রকমের বুদ্ধি দিয়ে সাহায়্য করে। যারা ব্যাংক ডাকাতি,ঋণ খেলাপি ও বিতর্কিত- তারা অনেকেই আজ সরকারি সংস্থার নীতিনির্ধারক।
আজকাল ঘুষ না দিলে কোন কাজ হয় না। দুর্নীতি ও ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দেশের মানুষের কাছে নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশে অভাবের কারণে খুব বেশি মানুষ দুর্নীতি করে না, বরং দুর্নীতি হচ্ছে ব্যক্তির সীমাহীন লোভের কারণে।
দুনীর্তি ও ঘুষবিহীন জাতি গঠনের প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর্জন করেছি। কিন্ত দুঃখের বিষয় ৫৩ বছরের মধ্যেই আমরা আমাদের স্বাধীনতার প্রত্যয় অঙ্গীকার ও শপথ ভুলে গিয়েছি।
বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত হাত ধরে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়ন, বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সফলতা, যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়নসহ অবকাঠামোর বিশাল উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও মানুষের মানবিক মূল্যবোধের বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি।
প্রাসঙ্গিক কারণে এসে যায় দেশের মানুষের মানবিক মূলবোধের কথা। আমাদের দেশে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ দিন দিন ধ্বংস হতে চলেছে। দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করেছে অল্প কিছু মানুষ। পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থায় দেশে অল্প কিছু মানুষের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। তাদের সুবিধার জন্যে রাষ্ট্রের আইনকানুন তৈরি হয়েছে এবং এই কারণে কিছু মানুষ বাধ্য হচ্ছে স্বার্থপর হতে। অন্যদিকে শ্রেণি-বৈষম্য দিনদিন বেড়েই চলেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ বড়ই কষ্টে দিন কাটাচ্ছে বা ধ্বংস হতে চলেছে।
বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে জনগণের মাঝে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুকালের গল্পের নামে ছোট বয়স থেকে শিশুদের মিথ্যা শিখানো হচ্ছে। পারিবারিক শিক্ষা ও প্রতিযোগিতার নামে শিশুদের শেখানো হচ্ছে অসৎ মানবিক মূল্যবোধ, যা শিশুরা অজান্তেই তাদের মস্তিকে ধারণ করছে। ছোট থেকে একটি শিশুর মানসিক বিকাশে মনুষ্যত্বের চেয়ে অর্থের প্রয়োজনীয়তাকে মুখ্য বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সুকৌশলে শিশুদের মানবিক মূল্যবোধ না শিখিয়ে তাদের চিন্তায় একটি জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানেই অর্থের প্রাচুর্য্য। শিশুদের জন্য এই রকম শিক্ষাই মানবিক মূল্যবোধ নষ্টের জন্য দায়ী। যার প্রভাবে সমাজে দুনীর্তি ও অসৎ কাজ বেড়েই চলেছে।
ঐতিহাসিক ভাবে বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ কিন্তু নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, খাদ্য সংকটের কারণে বিভিন্ন জাতির মানুষ এক সময় নিজের মধ্যে মারামারি করতো এবং তাদের নৈতিকতা বলে কিছুই ছিল না। ইউরোপের অনেক দেশে অভাব ও ক্ষুধার তাড়নায় অনেক মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে নৌকা করে ডাকাতি করতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতো এবং সেইদেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশে নিয়ে আসতো। কারণে অকারণে তারা মানুষ হত্যা করতো। এই সকল ডাকাত দলগুলির নাম ভাইকিং হওয়ায় জাতি হিসাবে ভাইকিং পরিচিতি পায় ইউরোপের অনেক দেশে। এই সকল ভাইকিংরা আজ মানবতার শীর্ষের দেশ ও পৃথিবীর সুখি দেশগুলির তালিকায় প্রথম পর্যায়ে আছে।
আমাদের অঞ্চলে কখনও খাদ্যাভাব ছিল না, জাতিগতভাবে আমরা কখনই ডাকাতের জাতি ছিলাম না। কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা আমাদের নিজের দেশের সস্পদ চুরে করে বিদেশে পাঠাচ্ছি। দুর্নীতি করে দেশ-বিদেশে টাকার পাহাড় বানাচ্ছি।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক সরকারের শাসন আমলেই দুর্নীতি দমনে উদাসীনতা দেখিয়েছে। বিত্রনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত। বিত্রনপি-জামাত শাসনামলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে একাধারে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায়। প্রচারে দুর্নীতি দমনে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও কার্যত দুর্নীতি দমনে তারা উদাসীন। দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন আমলে এতো উন্নয়নমূলক কাজ ও অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে মানুষ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা দুর্নীতির সবচেয়ে ভাল প্রজননক্ষেত্র। পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়ায় পুরো বাংলাদেশ দুর্নীতির প্রজনন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমরা কেন ভাবি না আমাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রাপ্তি হওয়া উচিত? পরিশ্রম করে বড় হলে লজ্জা লাগে কেন আমাদের? সত্য কথা বলতে আমরা দিন দিন ভুলে যাচ্ছি কেন?
আসুন আমরা সবাই নিজেকে জানি, নিজের যা কিছু আছে সেটা নিয়ে ভাল থাকি এবং অন্যের কতো কী আছে তার হিসাব করা থেকে বিরত থাকি। আমরা দুর্নীতিকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে না দেই। সবাই নিজের প্রয়োজনে, ভবিষৎ প্রজন্মের জন্য আওয়াজ তুলি: দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবো।
মাহবুবুর রহমান: সাধারণ সম্পাদক, ডেনমার্ক আওয়ামী লীগ
এমআর/এসবি
আপনার মতামত লিখুন :