ইমতিয়াজ মাহমুদ: [১] জয়া আহসানের জন্য ছোট একটা প্রশস্তি লিখে ফেলি। আমাদের সিনেমা, নাটক, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপনÑ এসব মিলিয়ে যে ছোট জগৎটা, এই জগতের বেশির ভাগ লোকই, হোক সে শিল্পী বা কারিগর বা ব্যবসায়ী, খুবই ভিতু প্রকৃতির। ওদের ভীতি দুই রকমের। প্রথম ভীতি হচ্ছে প্রথা প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস এসব নিয়ে। দ্বিতীয় ভীতি হচ্ছে সংখ্যাগুরুকে নিয়ে। দুইটা আলাদা করে বলছি বটে, এই দুইটাই আবার পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যখন আমরা বলি প্রথা প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস ইত্যাদির ভয়- সেটাও আবার কোন না কোনোভাবে সংখ্যাগুরুর ভয়ও বটে। তথাপি এই দুই ভাগেই ভীতিটাকে ভাগ করলাম। আর অন্যদের কথা বাদ দিলাম আপাতত- কেবল শিল্পীদের কথাটাই আলোচনা করি এখানে। আপনি যদি লক্ষ্য করে দেখেন তাইলে দেখবেন যে আমাদের শিল্পীরা কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকেন। এরা এমন কোন কথা মুখে উচ্চারণ করেন না, যেটা কোনোভাবে দেশের প্রথা প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস এসবকে বা সংখ্যাগুরুকে রাগিয়ে দিতে পারে। আর পেশাগতভাবে এরা এমন কোনো কাজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকতে চান না, যেটা প্রথা প্রতিষ্ঠান বা সংখ্যাগুরু পছন্দ নাও করতে পারে। আর নিতান্ত যদি করেও ফেলেন এমন কোন নাটক বা বিজ্ঞাপন, কেউ একজন রেগে কিছু বললেই সঙ্গে সঙ্গে মাফ টাফ চেয়ে শিল্পকর্ম বা বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন। উদাহরণ দিলাম না, আপনারা অনেক উদাহরণ জানেন।
[২] এই ভীতির কারণে আমাদের দেশের শিল্পীদের বেশিরভাগই আদিবাসীদের সঙ্গে যেসব অন্যায় অত্যাচার হয় পাহাড়ে ও সমতলে সেগুলির বিরুদ্ধে কোনো শিল্পীকে দেখবেন না প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ করতে। কেন? কেননা আজ যদি চাকমা বম বা গারোদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো শিল্পী প্রতিবাদ করে দুইটা কথা বলেন তাইলে এই দেশের সংখ্যাগুরু মানুষদের মধ্যে কিছু হীন মানুষ ওদের বিপক্ষে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠবে। বিশেষ করে পাহাড়ের আদিবাসীদের পক্ষে কিছু বললে সেখানকার মুসলমান সেটেলাররা যে কি বিষাক্ত আক্রমণ আপনাকে করতে পারে সেটা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। জয়া আহসান হচ্ছেন একমাত্র চেনাজানা বড় শিল্পী, যাকে আমি দেখেছি প্রতিবাদ করতে। ২০১৭ সনের জুনমাসের শুরুতে লঙ্গদুতে এক শুক্রবারে আদিবাসীদের চারটি গ্রামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকশত ঘর। এইসব ঘরে যারা বাস করতো, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র আদিবাসী মানুষ, ঘরের সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে গেছে ওদের যথাসর্বস্ব। সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। শুক্রবার সকালে সেটেলাররা কর্মসূচী দিয়েছিল।
আমরা সকলেই জানতাম যে এই কর্মসূচি থেকে ওরা আদিবাসীদের গ্রামে হামলা করবে। কতজনকে বলেছিলাম, একটু ঠেকাতে চেষ্টা করেন, কেউ কিছু করেনি। একজন এমপিকেও অনুরোধ করেছিলাম, কিসসু করেননি তিনিও। সেদিন ওরা কয়েকশ ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৭ সনের জুনের দুই তিন তারিখের পুরনো খবরের কাগজ সন্ধান করলে সেইসব খবর এখনো দেখতে পাবেন। বাংলাদেশর অনেক বড় বড় শিল্পী খবরের কাগজে এসব খবর দেখেছেন। অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও জানতেন। জয়া আহসান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো শিল্পীকে সেদিন প্রতিবাদ করতে দেখিনি (অন্য কেউ যদি প্রতিবাদ করেও থাকেন, আমার সেগুলি চোখে পড়েনি। সেরকম কেউ থাকলে আমি তাঁদেরকেও সালাম জানাই। সেরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি)। জয়া আহসান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বাক্যে সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুব স্পষ্ট করে প্রতিবাদটা করেছিলেন।
[৩] শিল্পীদের কাছে আমরা এসব প্রত্যাশা করি। কেননা শিল্পীদের চেতনাই সাধারণত এরকম হয়, মানুষের বিপদে ওদের প্রাণ অন্যদের চেয়ে আগে কাঁদে। সারা দুনিয়াতেই দেখবেন শিল্পীরা আক্রান্ত মানুষের পাশে সবসময়ই দাঁড়াতে চেষ্টা করেন, ওদের হয়ে কথা বলেন, নানাভাবে প্রতিবাদটা প্রকাশ করেন। ফিলিস্তিনিদের প্রতি এরকম সমর্থন নিয়ে খোদ আমেরিকাতেও অনেক শিল্পী ওদের নিজেদের সরকারের বিপক্ষে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, নানাভাবে প্রতিবাদ করেছেন। সেদিন আমাদের দেশের সিনেমার শিল্পীরা এগিয়ে আসেননি, জয়া আহসান প্রতিবাদ করেছিলেন। জয়া আহসান তো খুবই রূপসী, এই জন্য তো আর এই অধমের সার্টিফিকেটের দরকার নেই। জয়া আমার খুব যে প্রিয় শিল্পী ছিলেন আগে সেকথা বলতে পারি না। ভালো শিল্পী, দেখতে ভালো, দক্ষ অভিনেত্রী সবই ঠিক আছে, তথাপি। সেই জুনে আমার দৃষ্টিতে জয়া পাল্টে গেলেন-এরপর জয়া আহসান যেন রূপসীর চেয়েও অধিক রূপসী হয়ে গেলেন। ওর ছবি দেখলে চেহারায় আমি যেন স্বতন্ত্র মহিমা দেখতে পাই। জয়া আহসানকে সেই থেকে আমার আরও অনেক বেশি ভালো লাগতে লাগলো, সুন্দর লাগতে লাগলো। কেন লাগবে না? যাদের ব্যথায় সেদিন আমি কেঁদেছি, একই ব্যথায় সেদিন জয়াও ব্যথিত ছিলেন। তিনি তো আমার আপনজন। আর অবহেলিত পশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথাও তো আমরা জানি। পথের কুকুরদের জন্যে নানারকম কর্মকাণ্ডে জয়া আহসনাএর অংশগ্রহণের খবর আপনারা কাগজেও দেখেছেন। অসহায় অবহেলিত প্রাণীদের পাশে পরম মমতায় দাঁড়াতে পারেন যিনি, তাঁকে ভালো না বেসে পারবেন আপনি?
[৪] জয়ার জন্মদিন গেলো কয়েকদিন আগে। খবরের কাগজে খবরটা দেখেছি, প্রথম আলো একটা সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করেছে এই উপলক্ষে। অনেকে দেখলাম জয়া আহসানের বয়স কত হলো সেটাও লিখেছে। জয়ার বয়স কত হলো সেই নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমি তো যৌবন দেখি প্রতিবাদের মধ্যে। অন্যায়ের যে প্রতিবাদ করে সেই তো ধারণ করে যৌবন-আর অন্যায়ের মুখে যে চুপ থাকে সে তো জড়াক্রান্ত বার্ধক্যে ভুগতে থাকা বৃদ্ধ, হোক তার বয়স আঠারো বা বিশ বা পঁচিশ। কেননা তারুণ্য বা যৌবন তো প্রতিবাদেরই অন্য নাম, বয়সের নয়। জয়া আহসান নামের অপরূপা প্রিয়দর্শিনী এই তরুণীকে আমি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। প্রার্থনায় বিশ্বাস করলে আমি হওয়ার জন্য কেবল অনন্তকালব্যাপী আয়ু প্রার্থনা করতাম। বেঁচে থাকুন আপনি, আনন্দ হোক। লেখক: আইনজীবী। ২-৭-২৪। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :