মাসকাওয়াথ আহসান: ঢালিউড মুভি তুফান-এর একটি গানের ভিডিও দেখলাম। সিনেমাটোগ্রাফি, মিয অ্যান্ড সিন, কস্টিউম, সংগীত-নৃত্যসহ সামগ্রিক উপস্থাপনায় এটি একটি সফল কমার্শিয়াল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার প্রতীতী বহন করে। এ চলচ্চিত্র উদ্যোগ প্রশংসনীয়। ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে দেখি এক অনুজপ্রতিম লেখক ও সাংবাদিক তুফান চলচ্চিত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে ওই চলচ্চিত্র পরিচালককে মাদ্রাসায় পড়ুয়া বলছেন। তার পোস্টের কমেন্টে আরো কয়েকজন অনুজপ্রতিম যারা আর্ট ফিল্ম বানাতে গিয়ে ঠিক জমাতে পারেননি তারা এসে মাদ্রাসায় পড়ুয়া পরিচালক টোনটা ধরে রগড় করছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল আর্ট ফিল্ম নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ভারতের এনিমেল চলচ্চিত্র সমালোচনা করতে গিয়ে কাউকে বলতে শুনিনি পরিচালক টোল কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিলেন। তাহলে বাংলাদেশে কেন মাদ্রাসায় পড়ুয়া পরিচয়টিকে সামনে এনে রগড় করতে হবে। এই মনোস্তত্বটা বুঝতে চেষ্টা করছি। এমনও নয় ফেসবুকে সমালোচনা মুখর অনুজপ্রতিমেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকা কিংবা পুনে থেকে চলচ্চিত্র পড়ে এসেছেন অথবা পশ্চিমা ডিগ্রি নিয়েছেন ফিল্মে। তাহলে এই গজদন্তে-র মাড়িটা কোথায়। বাংলাদেশের কমার্শিয়াল মুভি একসময় অত্যন্ত সফল ছিলো।
চলচ্চিত্রবোদ্ধা আলমগীর কবির ও তাঁর কয়েকজন তরুণ বন্ধু বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তুললে আমিও তাঁদের আয়োজিত লম্বা ফিল্ম কোর্স করেছিলাম। আমার তখন অবাক লেগেছিলো চলচ্চিত্র প্রদর্শন শেষে ওই চলচ্চিত্র নিয়ে ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস করার পরিবর্তে বাংলা কমার্শিয়াল মুভি নিয়ে রগড় বেশ প্রাধান্য পেতো। আমি সেসময় বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে পড়ালেখা করে এক একটা সেশানে যেতাম। আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রবীক্ষার অনুরাগী ছিলাম বেশ খানিকটা। সেখানে অন্যদের মতো কোনো রগড়ে না গিয়ে চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলাম বেশ সিরিয়াস ছিলেন ফিল্মের ক্রিটিক্যাল এনালাইসিসে। উনারা দুজনেই বলেছিলেন, কমার্শিয়াল মুভির কনটেন্ট নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু টেকনিক্যালি তারা বেশ সাউন্ড।
উনাদের সেই বক্তব্যের সত্যতা পেলাম তুফান চলচ্চিত্রের টেকনিক্যাল এবিলিটি দেখে। কনটেন্টে বলিউডের এনিম্যাল মুভির মতো মেলশভিনিজম আছে বলে মনে হলো। এনিম্যাল চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সমালোচনা দেখে তুফানের পরিচালক খানিকটা সাবধান হলে পারতেন বলে ধারণা করি। কুয়েন্টিন টারানটিনোর পাল্প ফিকশন যারা দেখেছেন তারা এই তুফান কিংবা এনিমেলের ফিল্ম জনরাটা চিনতে পারার কথা। এ হচ্ছে কোন চিন্তা না করে বিনোদন নেবার ছবি। টিকেটের পয়সা উশুল করে আসা কমার্শিয়ালিজম। এইখানে চিন্তার অপচয় অর্থহীন। চিন্তার অপচয় করার জন্য দেশে অসংখ্য ব্যর্থ আর্ট ফিলম তৈরি হয়। ঐসব ট্র্যাশ দেখে ইন্টেলেকচুয়াল স্টিমুলেশন নিতে পারেন আঁতেল দর্শকরা।
আমাদের ঢাকা শহরে স্মার্ট হবার জন্য কতগুলো কাজ করতে হয়, অস্ট্রেলিয়ান ইংলিশের মতো শ-তে চাপ দিয়ে বলতেসিলাম, খাইতেসিলাম বলতে হয়। কারণ ছ উচ্চারণে দুর্বলতা আছে বেশ কিছু মানুষের। গাঢ় ছ উচ্চারণ অনেকেই পারে না। ছ হালকা উচ্চারণে ছাগলের সৌরভ বয়ে আনে। সেসব ঢাকতে ছিলামের পরিবর্তে সিলাম বললেই আপনি বেশ নিব্বা-নিব্বি। তুফান-এর পরিচালক এই নিব্বা নিব্বি কোথায় পেলেন তা বুঝলাম না। তিনি বলতেসিলাম, খাইতেসিলাম ব্যবহার করে স্মার্টনেসের তুফান তুলতে গিয়ে ভুল করেছেন। বিকল্পধারার চলচ্চিত্র বাংলাদেশের ভাগ্যে ছিলোনা। কিন্তু ঐ ধারা থেকে কমার্শিয়াল বাংলা মুভি নিয়ে হাসাহাসি করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বিনাশ সাধন হয়েছে। চলচ্চিত্রের অভাবে সিনেমা হল বিলুপ্ত হয়েছে। এরকম দুচারটি হলের জায়গায় মাদ্রাসা নির্মিত হলে, আবার গেরুয়া প্রগতিশীলদের হা-হুতাশ, শুক্রবার দিনটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রত্যেক সপ্তাহে দুচারটে নতুন ছবি মুক্তি না পেলে সিনেমা হল টিকবে কী করে। সিনেমা না টিকলে ঐখানে মাদ্রাসা হলো নাকি আওয়ামী লীগ অফিস হলো তাতে আমাদের কী।
দেশের কমার্শিয়াল ছবি নিয়ে হাসাহাসি, ঢাকা শহরে স্মার্ট হবার আরেকটি সূচক। জগলু ও জগাইয়ের মতো আনস্মার্ট লোক সুদর্শন হিরো শাকিব খানকে নিয়ে হাসে। বেশ আইরনিক্যাল না ব্যাপারটা। এরকম বাতেন ও ভজহরি গোত্রের লোকেরা একসময় সুদর্শন ওয়াসীমকে নিয়ে হাসতো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিনাশ করে এমন নয় যে এরা হলিউডের ছবি দেখবে। ইংরেজি শিক্ষার যে বারোটা বেজেছে তাতে হলিউড এদের চায়ের কাপ নয়। বাকি থাকে বলিউড দেখে উত্তেজিত হওয়া আর টালিউড দেখে উহ আহ করা। বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিতে তৈরি নিওরিয়ালিজমের কমেডি নাটকগুলো আজো আমার খুব প্রিয়। কারণ শৈশব থেকে আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভক্ত ছিলাম। পাশাপাশি হলিউড-বলিউড ও বিশ্বচলচ্চিত্র দেখেছি। কিন্তু রাজ্জাক-সোহেল রানা-বুলবুল আহমেদ-ফারুক-ওয়াসিম-মাহমুদ কলি আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছেন সোনালী যুগের তারকা হিসেবে। দি রেইন নামে একটি চলচ্চিত্র ছিলো, এতে অভিনয় করেছিলেন অলিভিয়া ও ওয়াসীম। রুনা লায়লার দারুণ সব গান ছিলো ওতে। এরকম স্মার্ট ছবি এফডিসির পরিচালক বানিয়েছিলেন। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকারদের যদু বংশটি সবাই মিলে এরকম একটি চলচ্চিত্র বানাতে পারেননি। তাই বাংলা চলচ্চিত্রের রেজারেকশানে যে চলচ্চিত্রকাররা কাজ করছেন তাদের কর্কশ সমালোচনায় জর্জরিত না করে এদের বিকশিত হতে দিন। দেখবেন আপনার হাতছাড়া হওয়া শুক্রবারের ম্যাটিনি শোতে আবার দর্শকের ভিড় উপচে পড়বে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন লিপ সার্ভিস দিয়ে হয় না এটা হতে হয় কালচারাল এক্টিভিজমের মাধ্যমে যেখানে চলচ্চিত্র সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। ২১-৬-২৪। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :