শিরোনাম
◈ কুষ্টিয়ায় পদ্মার ভাঙনে জাতীয় গ্রিডের টাওয়ার নদীতে বিলীন ◈ ভারতে থাকার মেয়াদ শেষ হচ্ছে, কোন আইনের বলে ভারতে থাকবেন শেখ হাসিনা? ◈ (২০ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার ◈ স্থিতিশীল ডলারের দর, ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ◈ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘গ্যারান্টিতে’ নগদ টাকার সংকট কাটছে যে ৫ ব্যাংকের ◈ হত্যাকাণ্ড নিয়ে অপপ্রচার চলছে, জাবিতে কোন কমিটিই নেই : ছাত্রদল ◈ গণপিটুনিতে মৃত্যু: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দুঃখপ্রকাশ, বৈষম্যবিরোধীদের নিন্দা, ফেসবুকে নানা সমালোচনা ◈ ভারতের গোলা যাচ্ছে ইউক্রেনে, ক্ষুব্ধ রাশিয়া ◈ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সুনামগঞ্জে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার গ্রেফতার ◈ মব জাস্টিস শুধু সহিংসতা ও অন্যায় সৃষ্টি করে: সমন্বয়ক হাসনাত

প্রকাশিত : ০১ মে, ২০২২, ০২:৫৭ দুপুর
আপডেট : ০১ মে, ২০২২, ০৩:৩০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দীপক চৌধুরী :  আশাবাদী মুহিত গর্বভরে বলতেন, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হবে এক দৃপ্ত অহংকারের নাম

দীপক চৌধুরী : সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন পরিপূর্ণ ও সফল মানুষ ছিলেন একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন কোনো সেক্টর ছিল না যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। অর্থনীতি তো আছেই, শিল্পসংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। উদার, অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কৃতিমনা এবং একজন আপাদমস্তক সৎ মানুষ ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র,  লোকসাহিত্য, কবিতা, গান অর্থাৎ সংস্কৃতির এমন কোনো ডালপালা নেই যে, তিনি জানতেন না। এসব অনুষ্ঠানে কখনো তাঁকে আমরা প্রধান অতিথি হিসেবে দেখেছি, আবার দর্শক হিসেবেও দেখেছি।
 প্রায় একযুগ আগে ‘শাহ আবদুল করিম সম্মাননা উপলক্ষে’ বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে বাংলা ভাষার খ্যাতিমান গবেষকদেরও তাক লাগিয়েছিলেন। তাঁর এই সংক্ষিপ্ত লেখায় এই বাউল সম্রাটের জীবনের প্রতিটি ধাপের বিবরণ যেকোনো পাঠককেই মুগ্ধ করবে। সাংবাদিক ও গবেষক সুমনকুমার দাশ ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধনা-গ্রন্থ’ সম্পাদনা করেছিলেন।   

উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আবুল মাল আবদুল মুহিত  স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের জীবন-যাপন, চিন্তার সীমাবদ্ধতা বা প্রশস্ততা তাঁর মনোজগতে ছিল। আমার ধারণা, এ সময়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশে এরকম প্রতিভাবান নেই বললেই চলে। মুহিত প্রতিটি কাজই এতো মনোযোগ ও গুরুত্ব  দিয়ে করতেন যে, তাঁর সহকর্মীরাও বিস্মিত হতেন।  

দেশের একজন উজ্জ্বল ও সফল মানুষ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে হারিয়েছি ৩০ এপ্রিল। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান  রেখেছেন তিনি। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সফল ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন জনমনস্ক উদার ব্যক্তিত্ব।  যারা তাঁর কাছে গেছেন তিনি মনোযোগ ও ধৈর্যসহকারে তার কথা শুনতেন। তিনি যে, দেশের অর্থমন্ত্রী এটা যেনো মাথায়ই রাখতেন না। ফলে তৃণমলে বসবাসকারী মানুষের চাহিদাও তাঁর জানা সম্ভব ছিল। তৃণমলের মানুষের জীবন চলার প্রধান প্রতিবন্ধকতা ও  সমস্যাগুলো যাদের জানা থাকার কথা তারা জানতেন না, কিন্তু আমাদের প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও অর্থমন্ত্রী মুহিত জানতেন এবং তাদের কষ্ট বুঝতে পারতেন। প্রয়োজনে পাল্টা প্রশ্ন করে সবকিছু বুঝতে চাইতেন। এ কারণেই সকল বিষয়েই তাঁর পুরোপুরি ও সঠিক ধারণা ছিল।

 অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২ বার বাজেট দিয়েছেন। ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এ সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সব দ্রোহ, আন্দোলন ও সংগ্রামে মুহিত  ছিলেন সম্পৃক্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর  থেকে এখন পর্যন্ত  দেশে যতজন ভালো অর্থনীতিবিদ আমরা  পেয়েছি, মুহিত সাহেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ। এতোগুলো গুণের সমাবেশ না ঘটলে কারুর পক্ষে  রোগাক্রান্ত অর্থনীতি ও দেশকে উন্নীত করা যায় না। ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ’, ‘স্মৃতির মণিকোটা’সহ প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ রয়েছে তাঁর।  অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জীবন, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশ, আমাদের প্রশাসন, অর্থ ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি এসব রচনা করে গেছেন। অনেকের রচনাই যেখানে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে সেখানে অত্যন্ত সহজ কথায় বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন তিনি। এসবের মধ্যে  ‘স্মৃতির মণিকোঠায়’ নামে তাঁর অসাধারণ একটি গ্রন্থও রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আজকের শক্তিশালী অবস্থা ও  মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ঈর্ষণীয়  যে   প্রবৃদ্ধি, এর  পেছনে এ এম এ মুহিতের অবদান অনস্বীকার্য।  

‘জীবনটা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট’ এ ভাষায়ই মত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়। প্রথম আলো পত্রিকায় একবার সাক্ষাতকারে  তিনি বলেছেন,  ‘জীবনটা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। বলা যায় উন্নত মানের সন্তুষ্ট। কারণ, এ  দেশের উন্নয়নে আমার চিন্তা ও দর্শনের প্রতিফলন আছে এবং এ  দেশের উন্নয়নের আমিও একজন নীতিনির্ধারক।’
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি  নেওয়া আবদুল মুহিত বরাবরই একজন  মেধাবী মানুষ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম  শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার আগে অংশ  নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে তিনি  যোগ  দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)।

সিএসপিতে  যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব  নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষও ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অর্থমন্ত্রী থাকার সময় বলেছিলেন, ‘বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হবে এক দৃপ্ত অহংকারের নাম, এই স্বপ্নে বাকি জীবন  বেঁচে থাকতে চাই।’

মুহিত পরিবেশবাদীও ছিলেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে  আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। ২০০২-এ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি এএমএ মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থানলাভ করেন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা  স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন মুহিত।    

তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মুহিত। এরপর  থেকেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল  মোমেন বলেছেন,  ‘ওনার জীবনে  কোনো অপ্রাপ্তি ছিল না। তৃপ্তি নিয়ে তিনি পৃথিবী  থেকে বিদায় নিয়েছেন।  দেশকে অনেক কিছুই দিতে  পেরেছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিভাবক হারিয়েছি। আলোর দিশারি হিসেবে তাঁকে আমরা মিস করব।’
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেট শহরের  ধোপাদীঘির পাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট  জেলা মুসলিম লীগের কর্ণধার আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও  সৈয়দা শাহার বানু  চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী  সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড়  ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং  ছোট  ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।

মুহিতের স্মৃতিচারণা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ  দেশের রাজনীতিতে সৎ মানুষ  বেশি  নেই। তিনি শতভাগ একজন সৎ মানুষ ছিলেন।’ দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশ  যে আজকে স্বল্পোন্নত  দেশ  থেকে উন্নয়নশীল  দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে; সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা আছে।’

লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়