মনজুর এ আজিজ : মারাত্নক গ্যাসসংকটের কারণে রাজধানী জুড়েই চুলা জ্বলছে না। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। গ্যাসসংকটে ভুগছে পরিবহন খাতও। বর্তমানে দেশে দিনে মোট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৩৮০ কোটি ঘনফুট।
এর বিপরীতে পেট্রোবাংলা এর আগে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারলেও বর্তমানে দিচ্ছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে দৈনিক ঘাটতি থাকছে ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। আর এর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ, পরিবহন, শিল্প-কলকারখানা ও আবাসিকে।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহসাই গ্যাস সঙ্কট থেকে মুক্তি নেই। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদেও মতে, আমাদের গ্যাস-সংকট দীর্ঘকালের।
চাহিদার বিপরীতে সব সময়ই কম বেশি গ্যাস সংকট বিদ্যমান ছিল এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের সময় দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল দৈনিক ১৭৫ কোটি ঘনফুট। আর ওই সময়ে গ্যাসের চাহিদা ছিল ২০০ কোটি ঘনফুট।
এতে দৈনিক ঘাটতি পড়ে ২৫ কোটি ঘনফুট। এরপর সরকারের উদ্যোগের ফলে ২০১২ সাল নাগাদ গ্যাস উত্তোলন দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট বৃদ্ধি পেয়ে সরবরাহ সক্ষমতা হয় ২৭৫ কোটি ঘনফুট।
কিন্তু এ সময়ে গ্যাসের চাহিদা ৩০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাওয়ায় দৈনিক ২৫ কোটি ঘনফুটের বেশি ঘাটতি পড়তে থাকে। এরপর আড়াইমাস ধরে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় অব্যাহত এ ঘাটতি দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দাম অত্যন্ত চড়া থাকায় বিশ্ববাজার থেকে পর্যাপ্ত এলএনজি কিনতে পারছে না বাংলাদেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এলএনজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
রাশিয়ার গ্যাস না পেয়ে ইউরোপের দেশগুলো খোলাবাজার থেকে কিনছে। এতে দরটি বাংলাদেশের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সরকারও খোলাবাজার থেকে চড়া দামে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছে।
দেশে এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আনা হচ্ছে।
এতে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে এখন প্রায় ১৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই দর ছিল ১০ ডলারের কম। আর সিঙ্গাপুরের খোলাবাজার থেকে কেনা এলএনজি নিয়ে প্রতি মাসে তিনটি করে জাহাজ আসার কথা।
এখন বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৬০ ডলারের বেশি। গত জুনেও তা ৩৬ ডলারে ছিল। অথচ গত বছর নেমেছিল ৪ ডলারে। দাম বেশি থাকায় আপাতত খোলাবাজার থেকে এলএনজি না কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে গ্যাস সঙ্কটে পড়ে দেশ।
তবে আমদানিনির্ভরতা ভুল নীতি ছিল। তাই এখন ভুগতেই হবে, এটা কৃতকর্মের ফল বলে মনে করছেন ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম। তিনি বলেন, ইউরোপ এলএনজির বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। দাম আরও বাড়তে পারে। তাই পরিস্থিতির আপাতত উন্নতির সম্ভাবনা নেই।
এদিকে রাজধানী ও এর আশপাশে গ্যাস সরবরাহ করে দেশের শীর্ষ গ্যাস বিতরণকারী সরকারি কোম্পানি তিতাস গ্যাস। এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে তিতাস পাচ্ছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে তারা গ্রাহকদের গ্যাস দিতে পারছে না।
কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে গ্যাস সরবরাহ। এতে রান্না-বন্নার কাজ করতে পারছেন না গৃহিণীরা। আবার ১২ ঘন্টা গ্যাস না থাকায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা।
বাকি সময়েও গ্যাসের চাপ কম থাকছে। এতে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কম হচ্ছে।
তিতাস সূত্র বলছে, ঢাকার প্রায় সব এলাকা থেকেই আসছে অভিযোগ। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, কল্যাণপুর ও উত্তরা থেকে আসা অভিযোগ বেশি।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলতে হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে কারখানা। বাকি সময়েও গ্যাসের চাপ কম থাকছে।
এতে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ৬৪টি কারখানায় গ্যাস সরবরাহ ও পোশাক উৎপাদন পরিস্থিতি জানতে একটি জরিপ করেছে নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। জরিপে উঠে এসেছে, গত দুই মাসে কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।
গড়ে ১ দশমিক ৮ পিএসআই করে গ্যাস পেয়েছে তারা। এতে কারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানিয়েছেন, গ্যাস সেক্টরে ভবিষ্যৎ শঙ্কা নেই। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে আমরা কিছুটা নাজুক অবস্থায় রয়েছি সত্য।
আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, তাতে ভবিষ্যতে বেশি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেছে।
৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে জাতীয় গ্রিডে অন্তত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাড়ানো হবে। এরমধ্যে নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্রও আবিষ্কার হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে স্পট মার্কেটের প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজিসহ গড়ে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এখন প্রায় দুই হাজার ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
তার মধ্যে দেশীয় কূপগুলো থেকে আসছে দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আসছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি।
আমরা গভীর সমুদ্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছি। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ২৪টি ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করতে পারবো।
তিনি বলেন, ভোলায় ৩টি কূপ খননের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা নদীগর্ভে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি। সুনেত্র থেকে শুরু করে কিশোরগঞ্জের নিকলী হয়ে ভোলা পর্যন্ত গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
এতে আমাদের গ্যাসের চাহিদাও যেমন বাড়বে তেমনই উৎপাদনও বাড়বে। সম্পাদনা: আল আমিন
আপনার মতামত লিখুন :