শিরোনাম

প্রকাশিত : ১১ আগস্ট, ২০২২, ০৮:৪৭ সকাল
আপডেট : ২৫ আগস্ট, ২০২২, ০৫:৩৫ বিকাল

প্রতিবেদক : আশ্রাফুর রহমান রাসেল

আলোচনায় আইজিপি বেনজীর আহমেদের যুক্তরাষ্ট্র সফর!

জাতিসংঘের সদরদপ্তর

এম. মোশাররফ হোসাইন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আগামী ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর দেশটিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের চিফ অব পুলিশ সামিটে (ইউএনকপ) অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলে পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদকে মনোনীত করা হয়েছে। নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দফতরে এই সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবে।

ছয় সদস্যের মনোনীত এই প্রতিনিধি দলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তফা জামান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব মো. আসাদুজ্জামান, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি নাসিম ওয়াজেদ ও এআইজি মোহাম্মদ মাসুদ আলমের নাম রয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতর।

র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে বেনজীর আহমেদ ছাড়াও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) মো. আনোয়ার লতিফ খান ও র‌্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর মধ্যে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদ ও র‌্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর।

জাতিসংঘে পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক হলেও তাঁর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

এদিকে কোনো রকম অসুবিধা না হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। সোমবার (৮ আগস্ট) তিনি বলেছেন, আমরা আশা করছি, আইজিপি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবেন। আর কোনো সমস্যা যদি থাকে, তাহলে আমরা আগে জানার চেষ্টা করব। আমরা এখনো যোগাযোগ করিনি, সামনের দিনগুলোয় যোগাযোগ করব।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যাদের নিষেধাজ্ঞা দেয়, জাতিসংঘের মিটিংয়ে যেতে গেলে এ রকম একটি জেন্টলম্যান বা কনভেশন আছে। তবে আমরা অতীতে এই নিয়মের ব্যতিক্রমও দেখেছি। এটা না হওয়া পর্যন্ত আগে থেকে বলা মুশকিল।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জাতিসংঘের চিফ অব পুলিশ সামিটে (ইউএনকপ) আইজিপি বেনজির আহমেদের অংশ নেয়া প্রসঙ্গে সোমবার (৮ আগস্ট) জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাসচিব আন্থনি গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিক বলেছেন, সভায় প্রতিনিধিত্ব কে করবে এটা জাতিসংঘের তরফে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না বরং সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ দেশের প্রতিনিধি মনোনয়ন দিয়ে থাকে। তবে ভিসা এবং প্রবেশের অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতর থাকার কারণে ১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আমন্ত্রিতদের ভিসা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। তবে বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিদের ভিসা না দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদকে ভিসা দিতেও পারে, আবার নাও দিতে পারে।

 

অতীত উদাহরণ

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী, জাতিসংঘের আমন্ত্রণ পাওয়া ব্যক্তিদের ভিসা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে।

২০১৯ সালে ইরানের কর্মকর্তাদেরও ভিসা দেওয়া হয়েছে। তবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চলাফেরা সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল। আবার ২০১৪ সালে ওবামা প্রশাসন জাতিসংঘে ইরানের মনোনীত রাষ্ট্রদূত হামিদ আবুতালেবিকে ভিসা দেয়নি। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭৯ সালে ইরানে মার্কিন দূতাবাস দখল ও জিম্মি সংকটে ভূমিকা রাখার অভিযোগ ছিল।

নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত হলেও জাতিসংঘ সদর দপ্তর কর্তৃক অধিকৃত জায়গাটি জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক অধিকারের আওতাভুক্ত। তবে বহির্বিশ্ব থেকে সেখানে যেতে হলে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থাকতে হবে।

লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এসংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের আমন্ত্রণে সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশি কূটনীতিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য আইনের সঙ্গে এটি কিছুটা সাংঘর্ষিক।

অতীতে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও জাতিসংঘের ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যানকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এর প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৭ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন নিউ ইয়র্কের বদলে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল শুধু পিএলও নেতার যোগ দেওয়ার সুবিধার্থে।

 

জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তিতে যা আছে

১৯৪৭ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাতিসংঘের ‘হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়, যা একই বছরের ৩১ অক্টোবর সংস্থাটির সাধারণ পরিষদে গৃহীত এবং ২১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

চুক্তির ১১ ধারায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের অফিসিয়াল কাজে আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গকে মার্কিন সরকার সংস্থাটির হেডকোয়ার্টার ডিস্ট্রিক্টে ট্রানজিট করার ক্ষেত্রে কোনধরনের প্রতিবন্ধকতা আরোপ করবে না এবং এই ধরনের ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা প্রদান করবে।

চুক্তির ১২ ধারায় বলা হয়েছে, ১১-এর বিধানগুলি সেই বিভাগে উল্লেখ করা ব্যক্তিদের সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক নির্বিশেষে প্রযোজ্য হবে।

চুক্তির ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশীদের প্রবেশ সংক্রান্ত আইন ও প্রবিধানগুলি এমনভাবে প্রয়োগ করা হবে না, যাতে ধারা ১১-এ উল্লেখ করা সুযোগ-সুবিধাগুলিতে হস্তক্ষেপ করা হয়। যখন উল্লেখিত ব্যক্তিদের জন্য ভিসার প্রয়োজন হবে, তখন যত দ্রুত সম্ভব, কোনরকম চার্জ ছাড়াই তাদেরকে ভিসা প্রদান করবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশীদের বসবাস সংক্রান্ত আইন ও প্রবিধানগুলি এমনভাবে প্রয়োগ করা হবে না যাতে ধারা ১১-এ উল্লিখিত সুযোগ-সুবিধাগুলিতে হস্তক্ষেপ করা যায়।

 

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের কার্যালয় স্থাপনের সময়ে নিজেদের মধ্যকার চুক্তি ও দীর্ঘদিনধরে চলে আসা প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কারও সম্পর্ক না থাকলে বা নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংস্থাটিতে কেউ আমন্ত্রিত হলে মার্কিন সরকার তাকে ভিসা দিবে বলে স্বীকৃতি আছে। ইরান ও কিউবা-সহ আরও অনেক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই কিন্তু এই চুক্তিবলে সেসব দেশের কর্মকর্তারা জাতিসংঘে তাদের দায়িত্ব পালনে যাওয়া-আসা করছেন। অন্যকোন কাজে তারা ভিসা পাবেন না, কিন্তু জাতিসংঘের কাজে ভিসা পেতে কোন সমস্যা হয় না।

তিনি বলেন, পুলিশের আইজি আমেরিকা নয় জাতিসংঘ সফরে যাচ্ছেন, তাই তার ভিসা পেতে ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে ঝামেলা হওয়ার কোন কারন নেই।

জাতিসংঘের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কি ধরনের চুক্তি আছে, এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা দিতে না পারলেও, প্রচলিত রীতি আছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, জাতিসংঘের কার্যক্রমে যারা আমন্ত্রিত তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাহিরে। তাই পুলিশের আইজি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেতে কোন সমস্যা হবে না বলে তিনি জানান।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে জাতিসংঘের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তাই সংস্থাটির চার্টারের সঙ্গে যদি সংগতি বজায় না থাকে তাহলে বাংলাদেশের বড়ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এটা দেশের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর পরিস্থির সৃষ্টি করবে। কনফারেন্সের অযুহাতে বাংলাদেশ সরকার যদি এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি জাতিসংঘও এটাকে ভালো চোখে দেখবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই কোন গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে অথবা জাতিসংঘের আমন্ত্রণকে তারা সম্মান করবে, এই বিশ্বাস থেকেই সরকার এই সংক্রান্ত জিও করেছে বলে মনে করছেন পুলিশের সাবেক প্রধান এ কে এম শহীদুল হক।

তিনি বলেন, যখন তারা ভিসা চাইবে বা সেখানে যাওয়ার উদ্যোগ নিবে, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝার জন্য আমাদেরকে সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়