সুজন কৈরী: মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ, গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ সুগম করার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর এ স্মারকলিপি দেন মঞ্চের নেতারা। জাতীয় প্রেসক্লাবের বিপরীতে উদীচী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি মিছিল নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পথে পুলিশ তাদের বাধা দিলে মঞ্চের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জমা দেন।
প্রতিনিধি ছিলেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর জাকির হোসেন, প্রগতি লেখক সংঘ-এর সভাপতি গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং চারণ-এর সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান।
স্মারকলিপিতে দাবি জানানো হয়, গত কয়েক বছরে দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার যতো ঘটনা ঘটেছে, অবিলম্বে তার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত, এসব ঘটনার পেছনের পরিকল্পনাকারী, ইন্ধনদাতা, উস্কানিদাতা এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া, ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে উষ্কানিমূলক বক্তব্য বা আলোচনা নজরদারিতে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একইসাথে ভবিষ্যতে যাতে কেউ এধরনের ঘটনা না ঘটাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার নাম করে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
স্মারকলিপিতে মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, এপর্যন্ত যতোগুলো শিক্ষক লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসনের অবহেলা এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের যুক্ত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তাই ভবিষ্যতে দেশের কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটলে সেটি প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে সেখানকার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেয়া প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ-এর স্মারকলিপিতে দাবি জানানো হয়, যেকোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটার পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে, তা কোনোভাবেই সরকারি কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেয়া যাবে না। বরং যারা হামলা করেছে তাদের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
স্বাধীনতার অন্যতম মৌল চেতনা ছিল সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করা উল্লেখ করে মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ কাজে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি।
জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদী, মারফতিসহ মাটির সুরের লোক গান বা যাত্রাপালার মতো সুস্থ ধারার সংস্কৃতি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় তা চর্চ্চার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক বলয়, কেন্দ্র ও মুক্তমঞ্চ গড়ে তোলার দাবি জানায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
এছাড়া, মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে পুন:প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাাসিত অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ক্রিয়াশীল সংগঠনসমূহকে মুক্তভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তাই, দেশের জনগণের মানবিক সমৃদ্ধি ঘটাতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে জাতীয় বাজেটের এক শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার দাবি জানায় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ।
শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের অধিকাংশ জেলা ও উপজেলাতেও জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর অভিন্ন স্মারকলিপি পেশ করেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ-এর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
দেশজুড়ে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অব্যাহত শিক্ষক নির্যাতন, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ২৯ থেকে ৩১ জুলাই, ৩ দিন দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এর আগে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চের এই ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে গত ২৯ জুলাই বিকেলে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ। শিক্ষা-সংস্কৃতি-মনুষ্যত্ব রক্ষায়-রুখো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস- এই শ্লোগান নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে দলীয় গণসঙ্গীত, পথনাটক, একক ও বৃন্দ আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশন করেন বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পী-কর্মীরা।
এছাড়াও সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময় জুড়ে রং তুলিতে প্রতিবাদ শিরোনামে প্রতিবাদী চিত্রাঙ্কনে অংশগ্রহণ করেন দেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী জাহিম মোস্তফা, রাশেদুল হুদা, কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাস, সোহাগ বায়েজিদ, টাইগার নাজির এবং সনাতন মালো।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চের এসব কর্মসূচিতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ছাড়াও যেসব সংগঠন যুক্ত রয়েছে। সেগুলো হলো-প্রগতি লেখক সংঘ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, সমাজ অনুশীলন কেন্দ্র, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, প্রাচ্যনাট, আরণ্যক, বটতলা, থিয়েটার বায়ান্ন।
আপনার মতামত লিখুন :