এল আর বাদল ; বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না পেয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বিএনপি।
দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি সন্দেহ যেমন বাড়ছে, একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের লম্বা সময় এমনকি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এ ধরনের আলোচনায় সরকারের সঙ্গে অংশীজনদের এবং সর্বোপরি রাজনীতিতে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বিভাজন বা দূরত্ব বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার বিষয় কেন আলোচনায় আসছে এবং ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা কি সম্ভব? সূত্র, বিবিসি বাংলা
অন্যতম প্রধান দল বিএনপি নেতারা বলছেন, এ সরকারের বয়স আট মাস পার হলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হচ্ছে না, সেকারণে তৈরি হচ্ছে সন্দেহ এবং উঠছে নানা প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও দায় দেখছেন।
-- অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কেন আলোচনায়---
গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। এ সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, সেটা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান-এসব কর্মকাণ্ডের ওপরই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্ভর করবে বলে একটা ধারণা রয়েছে সব অংশীজন ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এখন নির্বাচন ডিসেম্বরে নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে, এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে এই বিতর্কের মধ্যে কিছুদিন ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গে নানা আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে।
এই আলোচনা ভিন্ন মাত্রা পায় সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও রাজনীতিকদের কারও কারও বক্তব্যে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১০ই এপ্রিল সুনামগঞ্জ সফরে গিয়ে সেখানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "ওই রাস্তা থেকে আমারে বলতেছিল, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন।"
তার এই বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায় কি না, এই প্রশ্ন তুলে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে ইঙ্গিত করে তিনি এ-ও বলেন, "দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চাইলে নির্বাচিত হয়ে আসেন। অনির্বাচিত কাউকে দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় মেনে নেবে না।"
নির্বাচিত-অনির্বাচিত নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেরও জবাব আসে সরকারের একজন উপদেষ্টার কাছ থেকে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত ১২ই এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, "আমরা অনির্বাচিত- এই কথা কে বলল? আমাদের তো ছাত্ররা, জনতা- যারা নাকি এই পরিবর্তনটা এনে দিয়েছে, তারাই সরকার গঠন করেছে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত আমরা।"
এসব বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিতর্ক বা আলোচনা আরও বাড়িয়ে দেয়। যদিও আলােচনা-সমালােচনার মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি সরকারের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলেননি। জনগণ তাকে বলেছে।
তিনি এই বক্তব্য দেওয়ার পরও বিতর্ক থামেনি। তবে বিশ্লেষকেরা ও রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন, সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পেছনে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ায় বিষয়টিও অন্যতম একটি কারণ।
--দায় রয়েছে বিএনপিরও --
অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসা বা পরিস্থিতির জন্য বিএনপির দায় রয়েছে বলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন।
লেখক', বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভোট হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, এই ধারণা থেকে দলটির নেতাকর্মীরা সারাদেশে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।"
মি. আহমদ মনে করেন, নেতাকর্মীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মানুষ পতিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছে না।
যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। সারা দেশে দলটির এবং এর অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনগুলোর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কার করাসহ সাংগঠনিক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজি, দখলের মতো অপরাধ থামানো যায়নি।
এখানেই বিএনপির দায় দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, এমন একটা ধারণা সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যেও তৈরি হয়েছে।
-- লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকলে উঠবে আইনগত প্রশ্ন --
অন্তর্বর্তী সরকার লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকলে প্রথমত আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সরকারের প্রতি তখন কতটা সমর্থন থাকবে, সেটিও একটি বিষয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
যেহেতু বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেকারণে গত বছরের অগাস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সমর্থনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নেওয়া হয়েছিল।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বিষয়টাকে ব্যখ্যা করেন ভিন্নভাবে। তিনি বিবিসিকে বলেন, আদালতের মতামত এবং রায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। মতামত মানার বাধ্যবাধকতা থাকে না, যেটা রায়ে থাকে।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার আসা ও সামরিক শাসন রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার সময়টাকে বৈধ্যতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে।
সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ্যতা দেওয়া হয়েছিল জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনকে।
এই দুটি সংশোধনীই আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। দুটি সংশোধনীই বাতিল করেছিল আদালত। রায়ে বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তা বা জাতীয় কোনো প্রয়োজনেই অসাংবিধানিক কোনো বিষয়কে বৈধতা দেওয়া যাবে না।
আইনজীবী শাহদীন মালিকের বক্তব্য হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই নির্বাচিত সংসদে বৈধতা দিতে হবে। সেখানে অনির্বাচিত সরকার পাঁচ বছর বা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলে আইনগত প্রশ্ন উঠতে পারে। বৈধতার প্রশ্নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
একটি অনির্বাচিত সরকার নির্বাচন না দিয়ে দীর্ঘ সময় থাকলে, এই সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
দেশের ভেতরেও এই সরকারের অংশীজন হিসেবে রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন পক্ষ রয়েছে। সেখানে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দ্রুত নির্বাচন চাইছে। ফলে অংশীজনদের সঙ্গেও সরকারের দূরত্ব বাড়তে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সরকারের সময় দীর্ঘ হলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেটা আমাদের চিন্তার ও ধারণার আড়ালে থাকতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে এ সরকারের লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকা কঠিন।
--- বিএনপির অসন্তুষ্টির প্রশ্নে সরকারের ব্যাখ্যা ভিন্নরকম---
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অন্য যে উপদেষ্টারা ছিলেন, তাদের একাধিক উপদেষ্টা বলেছেন, বিএনপি অসন্তুষ্ট হয়েছে,আলােচনায় এটা তাদের মনে হয়নি।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, "বিএনপির মহাসচিবের এটা বলার অবশ্যই অধিকার আছে। আমার কাছে ওনাদেরকে দেখে হ্যাপি লেগেছে যখন আমাদের ডায়লগটা শেষ হয়েছে। মনে হয়েছে ওনাদের মনে যে প্রশ্ন ছিল সেগুলোর উত্তর তারা পেয়েছেন। আমার কাছে তা মনে হয়েছে, ফখরুল ভাইয়ের কাছে অন্যরকম মনে হতে পারে।"
নির্বাচন কোনোভাবেই আগামী বছরের জুনের পরে যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, 'আমরা বিএনপিকে ক্যাটাগরিক্যালি বলেছি, নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের পরে যাবে না। যে যা কথা বলুক না কেন, এটা পুরো জাতির প্রতি প্রধান উপদেষ্টার অঙ্গীকার।
আসিফ নজরুল উল্লেখ করেন, ডিসেম্বরে সম্ভব হলে ডিসেম্বরে, জানুয়ারিতে সম্ভব হলে জানুয়ারিতেই নির্বাচন হবে বলে বিএনপিকে বৈঠকে বোঝানো হয়েছে ।
তবে বিভিন্ন সময় সরকারের উপদেষ্টারা নির্বাচন নিয়ে নানারকম মন্তব্য করেন, সে সব বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করছে বলে বিএনপি মনে করে।
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, উপদেষ্টাদের কারও কারও কথার মধ্যে যদি অস্পষ্টতা থাকে, যে যেটাই বলুক না কেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে যেটা বারবার বলেছেন, সেটাই সরকারের অবস্থান।
অন্য কারও বেফাঁস কথায় যেন বিভান্ত না হয়, সে কথাও বিএনপি নেতাদের বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।