এল আর বাদল; বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে পরপর দুটি ঘটনায় বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত সপ্তাহেই একজন নারী মডেলকে মধ্যরাতে আটক করে দুইদিন পরে এই আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেয়া হয়েছে, যা আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় বানানো মোটিফে আগুন দেয়ার ঘটনায় বিতর্কিত ওই আইনেই আবার মামলা হয়েছে। -- সূত্র, বিবিসি বাংলা
এ নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই রোববার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, "মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার করার প্রক্রিয়াটা হয়তো ঠিক হয় নাই। বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগটা ঠিক হয় নি।
মডেল মেঘনা আলমকে কেন মুক্তি দেয়া হবে না এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের আটকাদেশকে কেনও আইন বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এসব ঘটনার মধ্যে আবার বিতর্কিত ওই আইনের প্রয়োগ দেখা গেল।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন আইন প্রয়োগ করে কোনও ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে।
আইনটি কার্যকরের পর থেকেই এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারের সময় এই আইনে গ্রেফতার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও কেন এই আইনের প্রয়োগ করতে হলো সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।
বিরোধীরা বরাবরই এই আইনের সমালোচনা করে আসলেও কোন সরকারই আইনটি বাতিলের উদ্যোগ নেয়নি।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার রহিত হচ্ছে এবং এটি মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।
-- আইনটি নিয়ে নতুন বিতর্ক কেন? --
এই আইনটি নিয়ে নতুন করেআলোচনার সূত্রপাত হয় গত নয়ই এপ্রিল থেকে। ওইদিন রাতে তাকে একজন নারী মডেল মেঘনা আলমকে ঢাকার বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ ছাড়াই মডেল মেঘনা আলমকে সোমবার মধ্যরাতে দরজা ভেঙ্গে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন বা কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে কাউকে জানানো হয়নি। এর দুই দিন পরে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর এ নিয়ে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়।
আটকের ঘটনার তিনদিন পর গত শুক্রবার পুলিশ জানিয়েছে, এই নারীকে সুনির্দিষ্ট কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে 'নিরাপত্তা হেফাজতে' রাখা হয়েছে।
এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রোববার ঢাকা মহানগরের ডিবি প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে চারুকলা ইন্সটিটিউটে আগুনের ঘটনায় এই আইনে মামলা হয়েছে।
নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় তৈরি করা 'ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' ও একটি শান্তির পায়রা মোটিফে গত শনিবার ভোররাতে আগুন দেয় একজন যুবক।
ওই ঘটনায় শনিবার রাজধানীর শাহবাগ থানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে। এই মামলাটিও বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুর।
মি. মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে অজ্ঞাতনামা কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।"
কিন্তু এই মামলাটিও কেন বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা হলো সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
শাহবাগ থানার ওসি মি. মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলেন, "মামলা পুলিশ দায়ের করেনি, করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুতরাং বাদী কি আইনে মামলা করবে সেটি বাদীর ওপর নির্ভর করে। পুলিশের কোন এখতিয়ার নেই এ বিষয়ে"।
যদিও আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন বলছেন, থানায় যখন কোন মামলা হয় তখন সেটি কোন আইন বা ধারায় হবে সেটি পুলিশই বলে দেয়।
মানবাধিকার সংগঠক নুর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "শাহবাগ থানায় বিশেষ আইনে দায়ের করা ওই মামলাটি উর্ধতন পুলিশের নির্দেশে হতে পারে। কোন আইনে মামলা হবে এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। এটা অভিযোগকারীর না।
-- বিশেষ ক্ষমতা আইন কী?--
বিশেষ ক্ষমতা আইনটি পাস করা হয়েছিলো ১৯৭৪ সালে। এই আইন অনুযায়ী, নির্বাহী কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য যে কাউকে আটক করতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইনটি পাস করা হয় ।
আইনজীবীরা জানান, যুদ্ধের পরপরই ওই সময়ে অনেকের হাতে অস্ত্র ছিল, পুলিশ বাহিনী সুসংগঠিত ছিল না, বামপন্থীরা রাতারাতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতে শৃঙ্খলা ফেরাতেই এই আইনটি করা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ ১৯৭৪ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি আইনটি পাস করে। আইন পাশের পর আওয়ামী লীগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। সমালোচকরা এই আইনটিকে 'কালো আইন' বলেও অভিহিত করে।
আইনজীবীরা বলছেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই আইনটির নানা অপব্যবহার হয়েছে। যে কারণে এই আইনটি নিয়ে নানা বিতর্কও হয়েছে।
আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এই আইনে কাউকে বিনা বিচারের আটক করার ক্ষমতাই মূল বিতর্কের জায়গা। এর কিছু অপপ্রয়োগ আমরা সত্তর আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আমরা দেখেছি"।
তিনি বলেন, "এই আইনের বেশি উদ্বেগের জায়গা সেকশন থ্রি (তিন ধারা) নিয়ে। প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের বিরোধিতা আমরা সব সময়ই করেছি। বাংলাদেশের যারা আইনজীবী আছেন তারা এটি নিয়ে সব সময়ই উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন"।
যেসব কারণে আইনটির সমালোচনা করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আইনটির অধীনে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তিকে আটক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল পুলিশকে।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪' দেশের বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সংবিধান একজন নাগরিককে যে অধিকার দিয়েছে, সেটারও পরিপন্থি।
আইনজীবীরা এই আইনের কয়েকটি ধারার কথা উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলছেন, এই সেকশনে তিন, চার ও পাঁচ নং ধারা অনুসরণ করে যে কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখতে পারবেন।
তারা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের এই আইনের বেশ কিছু অপপ্রয়োগের কথাও তুলে ধরেন আইনজীবীরা।
আইনজীবী মি. ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এটা এমন একটা অস্ত্র যেটা দিয়ে মানুষকে খুব সহজেই হিউমিলিট করা যায়। সরকার এই আইনের আশ্রয় নিয়ে কাউকে ঘায়েল করতে পারে সহজে। যে কারণে এই আইনটি নিয়ে নানা সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছে"।
মূলত, পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফশিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো।
আইনের কয়েকটি ধারার কথা উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলছেন, এই বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। একই সাথে আইনটি সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক।
মানবাধিকার সংগঠক নুর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কারণ এই আইনটির মাধ্যমে মানুষের মানবাধিকার ক্ষুন্ন হয়। বিগত স্বৈরাচারের আমলেও এটার প্রয়োগ আমরা দেখিনি"।
এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিলে এটি নিয়ে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে বলেও শঙ্কার কথা জানান এই মানবাধিকার সংগঠক।
-- বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে আদালতের রুল--
মডেল মেঘনা আলমকে কেন মুক্তি দেয়া হবে না এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের আটকাদেশকে কেনও আইন বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।
এছাড়া যে প্রক্রিয়ায় বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে তা অসাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি কেন নয় তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
রোববার বিচারপতি রাজিক আল জলিলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।
এসময় আদালত স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশের আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, জেলা ম্যাাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিস্টদের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
মেঘনা আলমের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেছিলেন তার বাবা বদরুল আলম। আদালতে রিটের ওপর শুনানি করেন আইনজীবী সারা হোসেন ও জাহেদ ইকবাল।
পরে সাংবাদিকদের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, আদালত দুটি বিষয়ে রুল জারি করেছে। এর একটি হলো কেন তাকে বাড়ী থেকে ওয়ারেন্ট ছাড়া ও কোন কারণ না দেখিয়ে নেয়া হয়েছে এবং কেন তাকে ডিবি অফিসে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখা হয়েছে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না দিয়ে।
আরেকটি হলো, বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে ডিটেনশন অর্ডার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টেট্র ইস্যু করেছেন সেটাকে কেন আইন বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি দেয়া হবে না।
আদেশে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(এফ) ধারায় জননিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থি ক্ষতিকর কার্য থেকে নিবৃত্ত করার জন্য এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এই আটকাদেশ দেয়া হয়েছে। পরে মেঘনা আলমকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।