শিরোনাম
◈ বাংলাদেশের আইনে কী আছে পুরুষদের ধর্ষণের বিষয়ে? ◈ কূটনীতিকের কানাডায় পালিয়ে গিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য, যা বললো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ◈ আমরা যথেষ্ট ভাগ্যবান, কারণ আমাদের সমুদ্র আছে : প্রধান উপদেষ্টা ◈ ছয় মাস পর জাতীয় দলে ফিরলেন এমবাপ্পে ◈ ইউএনও’র সহযোগিতায় হুইল চেয়ার পেয়ে আবেগে বললো এবার আমি স্কুলে যেতে পারবো  ◈ যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৩৮৩ জন গ্রেফতার ◈ খুরুশকুলের জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প পরিদর্শন করলেন প্রধান উপদেষ্টা ◈ বিশ্বে প্রথমবার স্বর্ণের দাম তিন হাজার ডলার প্রতি আউন্স ◈ নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক: ড. আবদুল মঈন খান ◈ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ নাও হতে পারে ব্রাজিলের

প্রকাশিত : ১৪ মার্চ, ২০২৫, ০৫:০২ বিকাল
আপডেট : ১৪ মার্চ, ২০২৫, ০৯:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

দেশ ছেড়ে যারা আগেই চলে গেছেন তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কেন দেওয়া হয়?

বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। তবে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তাদের অনেকেই ইতিমধ্যেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাই প্রশ্ন উঠেছে—যারা ইতিমধ্যেই দেশের বাইরে চলে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কেন?

উদাহরণস্বরূপ, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান, সঙ্গে ছিলেন বোন শেখ রেহানা। 

কিন্তু ভারতে পলানোর প্রায় সাত মাস পর হাসিনা, তার ছেল-মেয়ে ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে গত ১১ মার্চ ঢাকার আদালতে আবেদন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আদালত সে আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। অথচ তাদের সবাই আগে থেকেই বিদেশে বসবাস করছেন। 

শুধু শেখ পরিবারের সদস্য নয়—গত সেপ্টেম্বর থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত অর্থ পাচার, ব্যাংক বা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত, জ্ঞাত অয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় ২৫০ জন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দিয়েছেন আদালত। 

তবে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞায় পড়াদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে আগেই জানা গেছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধানকালে একসময় দুদক আইন অনুযায়ী সংস্থাটি নিজেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়ে বিভিন্ন বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে সংশ্লিষ্টদের কাছে নোটিশ পাঠাত। কিন্তু হাইকোর্টের একটি রায়ের কারণে গত কয়েক বছর ধরে এক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক হয়েছে। এখন কারো বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য সংস্থাটিকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। 

এই আইনজ্ঞ বলেন, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বিদেশে অবস্থান করছেন বা পালিয়ে গেছেন, এটি জানার পরও তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা অনর্থক। এত করে আদালতের সময় নষ্ট হচ্ছে। এই ধরনের আবেদন করার জন্য দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেই সময় ব্যায় করতে হচ্ছে। অর্থ ও সময় দুটোই নষ্ট হচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন বা অবস্থান করছেন, তাদেরকে ফেরত আনতে উদ্যোগ নিতে পারে দুদক। বিন্তু সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। 

উদাহরণ দিতে গিয়ে এই আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, পিকে হালদারকে দুর্নীতর মামলায় কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তিনি ভারতের কাগারে আটক ছিলেন সেখানকার অন্য মামলায়, আবার জামিনও পেয়েছেন। কিন্তু তাকে ফেরত আনার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি দুদক। 

এরকম নিষেধাজ্ঞার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছরের ১২ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও তার স্ত্রী আফরীন তাপসের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। 

কিন্তু তিনি ৩ আগস্ট দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন বলে টিবিএসকে নিশ্চিত করেছে পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ। 

এর আগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ভারতে থাকার ভিডিও দেখা যায়। এরপরও গত ১ সেপ্টেম্বর স্ত্রী-সন্তানসহ তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। 

একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের দুবাইয়ে থাকার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরও দুদক গত ২৫ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী-সন্তানসহ তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

ইতিমধ্যে বিদেশে চলে যাওয়া ব্যক্তিদের ওপর কেন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্ন করা হলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম টিবিএসকে বলেন, 'রাষ্ট্রপক্ষ বিভিন্ন গণমাধ্যমের মারফতে জানতে পারে, শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা দেশ ছেড়েছেন। কিন্তু কোথায় আছেন, কেউ সঠিক বলতে পারেন না। রাষ্ট্রের কাছে ডকুমেন্টারি কোনও এভিডেন্স (সাক্ষ্য-প্রমাণ) নেই।

'যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছে প্রমাণিত নয় যে তারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারে দুদক।'

রুটিন প্রক্রিয়া : অ্যাডভোকেট সালাম জানান, মামলা দায়েরের সময় আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে থাকেন তারা। ফলে তা-ও শুনানিতে চলে আসে। 'যখন দুর্নীতির অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তখনই প্রসিডিওর অনুযায়ী তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের কেউ যদি দেশে আসেন, আর ফেরত যেতে পারেন না।'

তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ১৫০ থেকে ২০০-র বেশি নেতা-কর্মীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও শতাধিক ব্যবসায়ী, আমলা ও সরকারি চাকুরজীবী ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

সালাম বলেন, 'তাদের অধিকাংশই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে আমি শুনেছি। তবে রাষ্ট্রের কাছে প্রমাণিত না হওয়ায় আমরা ধরে নিই, তারা দেশের মধ্যে অবস্থান করছে।'

বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আবেদন করে সময় বা অর্থ অপচয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এখানে অর্থ বা সময় অপচয়ের কোনো বিষয় নেই। আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অংশ এটি।'

দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'দুর্নীতির অভিযোগে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা আসামির বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কারণ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত কোনো প্রক্রিয়া বাকি রয়েছে, এমন কোনো প্রশ্ন যাতে না ওঠে। সেসব দিক বিবেচনা করেই দেশের বাইরে থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।'

দুদক মহাপরিচালক (প্রিভেনশন) আক্তার হোসেনও একই ধরনের মত দেন।

তিনি টিবিএসকে বলেন, 'দাপ্তরিকভাবে বা দালিলিকভাবে আমরা জানি না তারা দেশে আছেন নাকি পালিয়ে গেছেন। যেহেতু আমরা অনেক বিষয় রেকর্ডভিত্তিক জানি না, সে কারণে আমাদের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মনে করছেন যে তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন রয়েছে এবং সে অনুযায়ী তারা আদালতে আবেদন করছেন।'

দেশ ছাড়ার পর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার নজির প্রচুর :  গত বছরের ৭ অক্টোবর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। 

চলতি বছরের ৬ মার্চ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। 

আবেদনে দুদকের উপপরিচালক মোজাম্মিল হক বলেন, 'খায়রুজ্জামান লিটন এবং ছয়টি সংসদীয় আসনের সাবেক আট সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাৎ করে আত্মগোপনে যাওয়ার অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। এজন্য তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।' 

অর্থাৎ দেশ ছাড়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে দুদক।

এ বছরের ৪ মার্চ দুদকের আবেদনে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের ১১ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। 

বিভিন্ন সূত্র বলছে, তিনি অনেক আগে থেকেই সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। 

এছাড়া বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চায় দুদক। আদালত তা মঞ্জুর করেন। একইভাবে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদেরও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনই বিদেশে অবস্থান করছেন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের আবেদনে ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী ও তার স্ত্রী তারিন হোসেনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তবে নিষেজ্ঞার আগে থেকেই নিক্সন চৌধুরীর দেশের বাইরে অবস্থান করার বিষয়ে জানা গেছে।

গত বছরের ২৭ আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে সূত্র বলছে, হারুন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেয়ারবাজার কারসাজি ও অর্থপাচারের অভিযোগে এনআরবিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনিও দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

আইনি ভিত্তি আছে কি?: বিদেশে অবস্থান করার পরও দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুদক যে আবেদন করে, সেটি কতটুকু যৌক্তিক—এ বিষয়ে অ্যটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'দুদক যা করছে, আইন মেনেই করছে। কারও পালিয়ে যাওয়ার অনুষ্ঠানিক তথ্য যদি কারও কাছে না থাকে, সে বিষয়ে এই আইনের প্রয়োগে কোনো বাধা নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'কোনো ব্যক্তিকে আটক, গ্রেপ্তারচেষ্টা বা আদালতে আত্মসমর্ফন না করা পর্যন্ত তাকে পলাতিক বলা হয় আইনের চোখে। তিনি কোথায় পলাতক রয়েছেন, সেটি দুদকের বিষয় না। যাতে পালাতে না পারেন, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়