২০২০ সালে করোনার প্রকোপের সময়ে ৬৪ জেলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকারি সহায়তায় দায়িত্ব পালন করা সচিবদের আমলনামা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে তাদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচাই চলছে। সেই সময়ে ‘লকডাউন’ চলাকালে প্রান্তিক মানুষকে সরাসরি সহায়তার উদ্যোগের পর ত্রাণ ও টাকা বিতরণে প্রভাব বিস্তার, ডিসিদের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের ওপর আক্রমণে সহযোগিতার আশ্বাসসহ জেলার উন্নয়ন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬৪ জেলায় দায়িত্ব পালন করা ৬৪ জন সচিবের তথ্য সংগ্রহ করছে সরকার। এরইমধ্যে এই ৬৪ সচিবের সবাই অবসরেও গেছেন। তবে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযুক্ত থাকায় কয়েকজনকে আবার গ্রেফতারও করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। খবর: বাংলাট্রিবিউন।
জানা গেছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে সারা দেশে কয়েক দফায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সে সময় জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সবাইকে ঘরে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ সময় মানুষকে সহায়তার জন্য ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয় সরকার। অভিযোগ উঠেছে, ৬৪ জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক এই সচিবরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাদের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদের ইচ্ছায় সবকিছু পরিচালিত হয়েছে। অনেকেই সহায়তার অর্থ ঠিকমতো পায়নি।
গ্রামে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করা এবং তাদের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতে গিয়ে সচিবরা শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের কাজ আমলাদের দিয়ে করানোয় সংসদে বিতর্ক তোলা হলেও পদ-পদবি হারানোর ভয়ে মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিবাদ বেশি দূর এগোয়নি। করোনার ওই সময় যে ৬৪ সচিব সরকারি ত্রাণ বিলি-বণ্টন এবং দুর্গতদের তালিকা করার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ভূমিকা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তারা ‘কট্টর আওয়ামী সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত। ওই সচিবদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।
করোনার সময় বিভিন্ন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে জনপ্রতিনিধিদের করা সেই তালিকাকে অনেকাংশে গুরুত্ব না দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিজেদের করা তালিকা অনুযায়ী সরকারি সহায়তার অর্থসহ নানা ধরনের সুবিধাদি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, এতে লাখ লাখ প্রান্তিক অসহায় জনগোষ্ঠী সহায়তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগ তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে করা হলেও বিষয়টি আমলে আনা হয়নি। পরবর্তী সময়ে করোনাকালে সরকারি সহায়তার নামে শত শত কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২ কোটি মানুষকে তথা ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেয় তখনকার সরকার। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ১৫ লাখ পরিবারের কাছে টাকা পৌঁছানো যায়নি যথাযথ তথ্যভাণ্ডারের অভাবে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ কৃষককে এককালীন ৫ হাজার টাকা করে নগদের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রতি জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দিয়ে আদেশ জারি করেছিল তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা ওই অফিস আদেশে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব বা সচিবরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয় কাজে তার মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা দপ্তর সংস্থার উপযুক্ত সংখ্যক কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন। নিয়োগ করা কর্মকর্তারা জেলার সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণমাধ্যম ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে কোডিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার কাজ তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ করবেন। পাশাপাশি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করবেন। সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ বা অন্য বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা দপ্তর বা সংস্থাকে লিখিত আকারে জানাবেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে নিয়মিত অবহিত করবেন। আরো বলা হয়, অবসর বা বদলির কারণে সিনিয়র সচিব বা সচিবের দপ্তর পরিবর্তন বা পদ শূন্য হলে সেখানে নিযুক্ত সিনিয়র সচিব বা সচিব দায়িত্ব পালন করবেন।
আদেশে উল্লেখ করা দায়িত্ব পালন করা সচিবরা ছিলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম (মুন্সীগঞ্জ), আইসিটি বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম (কুমিল্লা), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম (সিরাজগঞ্জ), জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন (চট্টগ্রাম), স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ (কক্সবাজার), জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব এবং নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান (শরীয়তপুর), পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার (মানিকগঞ্জ), প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (যশোর), কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম (লালমনিরহাট), গণপূর্ত সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার (গোপালগঞ্জ), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (রাঙামাটি), প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সাবেক সচিব পবন চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর), সড়ক বিভাগের সাবেক সচিব মো. নজরুল ইসলাম (শেরপুর), ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ (ফরিদপুর), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অ্যাকাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবুল কাশেম (রাজশাহী), কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক সত্যব্রত সাহা (গাজীপুর), শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এম আলী আজম (বরিশাল), সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন (বান্দরবান), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন (সাতক্ষীরা), বিপিএটিসির রেক্টর মো. রকিব হোসেন (নারায়ণগঞ্জ), যুব ও ক্রীড়া সচিব মো. আখতার হোসেন (মাদারীপুর), রেল সচিব সেলিম রেজা (পাবনা), পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া (সিলেট), সমবায় সচিব রেজাউল আহসান (রংপুর), মুক্তিযুদ্ধ সচিব তপন কান্তি ঘোষ (বি.বাড়িয়া), খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম (চুয়াডাঙ্গা), শিক্ষা সচিব মো. মাহবুব হোসেন (জামালপুর), মৎস্য সচিব রওনক মাহমুদ (পটুয়াখালী), স্বাস্থ্যশিক্ষা সচিব মো. আলী নূর (ঢাকা), পরিকল্পনা সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী (সুনামগঞ্জ), মো. নুরুল ইসলাম (দিনাজপুর) ও বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর বদরুন নেছা (নরসিংদী)।
এছাড়াও দায়িত্ব পালন করেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া (পিরোজপুর), পরিবেশ সচিব জিয়াউল হাসান (কুড়িগ্রাম), স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান (কিশোরগঞ্জ), প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম (নীলফামারী), কারিগরি ও মাদরাসা সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান (মৌলভীবাজার), ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন (বগুড়া), নৌসচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী), মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (সমন্বয়) সচিব মো. কামাল হোসেন (খুলনা), পিপিপির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা আফরোজ (কুষ্টিয়া), শ্রম সচিব একেএম আবদুস সালাম (নওগাঁ), আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী (নোয়াখালী), পরিসংখ্যান সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী (নাটোর), পিএসসি সচিব মোছা. আছিয়া খাতুন (রাজবাড়ী), দুর্যোগ সচিব মোহাম্মদ মোহসীন (চাঁদপুর), সংস্কৃতি সচিব মো. বদরুল আরেফীন (খাগড়াছড়ি), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মো. মামুন আল রশীদ (হবিগঞ্জ), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম (মাগুরা), পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দুলাল কৃষ্ণ সাহা (গাইবান্ধা), বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান (বরগুনা), তথ্য সচিব খাজা মিয়া (নড়াইল), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস (টাঙ্গাইল), ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল (ঝিনাইদহ), বিমান সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন (মেহেরপুর), ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান (পঞ্চগড়), জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জাকিয়া সুলতানা (নেত্রকোনা), সমাজকল্যাণ সচিব মাহফুজা আখতার (বাগেরহাট), ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার (ঝালকাঠি), পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শরিফা খান (ঠাকুরগাঁও), পার্বত্য সচিব মোছাম্মৎ হামিদা বেগম (ময়মনসিংহ), ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মোকাব্বির হোসেন (ভোলা) এবং মহিলা ও শিশুসচিব সায়েদুল ইসলাম (জয়পুরহাট)।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোভিড-১৯-এর সময় ত্রাণ ও টাকা বিতরণের অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হবে। সেই সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা কী কী দায়িত্ব পালন করেছেন, সেসব তথ্য জানতে চাওয়া হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।