বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে গঠিত হতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দল। আগামী ২৮শে ফেব্রুয়ারি সেই নতুন দল আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। নতুন দলের নাম কী হবে, তার উত্তর মিলবে ওইদিনই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা আন্দোলন শুরুর পর তা নানা বাঁকবদলের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। একপর্যায়ে গত পাঁচই অগাস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়।
তার কিছুদিন পর গুঞ্জন ওঠে যে আন্দোলনের নেতৃ্ত্বে থাকা শিক্ষার্থীরা নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা পরিষ্কারও হয়।
নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে গতকাল ২৫শে ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নাহিদ ইসলাম। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন দলের প্রধান হিসাবে তার থাকার বিষয়টি একপ্রকার চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়, এর প্রক্রিয়াগুলো কেমন, চাইলেই কেউ দল গঠন করতে পারে কি?
বর্তমান নিয়মে নিবন্ধনের শর্ত: বাংলাদেশের যে কেউ চাইলেই নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেই সবাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
কারণ নতুন দলকে "নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে", বিবিসিকে বলছিলেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের তথ্য বলছে, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ দলের নিবন্ধন হয়েছে ২০০৮ সালে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে চারটি দল নিবন্ধন লাভ করেছে। এর আগে ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি দলকে নিবন্ধন প্রদান করা হয়।
এর মধ্যে 'তৃণমূল বিএনপি', 'ইনসানিয়াত বিপ্লব-বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম' এবং 'বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির' নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনি মাঠে প্রধান বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব দল তৈরি হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন বা ভোটাধিকার সম্পর্কিত যতগুলো আইন আছে, তার মধ্যে একটি হলো আরপিও (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আইন।
সেখানে অধ্যায় ৬ক-তে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কিছু শর্ত আছে। এ উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন 'রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮' শীর্ষক একটি বিধিমালাও প্রণয়ন করেছে।
সেখানে তিনটি শর্তের কথা বলা হয়েছে, নিবন্ধন পেতে হলে সেগুলোর যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে। সেই শর্তগুলোর মাঝে রয়েছে—
১। স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত যে কোনও সংসদ নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনি প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসনে জয়ী হওয়ার রেকর্ড থাকতে হবে
২। যে কোনও একটি আসনে দলীয় প্রার্থীকে মোট প্রদত্ত ভোটের পাঁচ শতাংশ পেতে হবে
৩। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয়, অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হবে
এছাড়া, নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলগুলোকে তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ দলের সকল স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব অর্জন, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে না রাখা এবং বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য তৃণমূলের ভোটে প্যানেল প্রস্তুত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান রাখার কথাও আইনে উল্লেখ আছে।
তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এসব নিয়মের অনেককিছু শিথিল করেছে। যদিও কমিশনের সেসব সুপারিশ অনুযায়ী এখনও আইন সংশোধন করা হয়নি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, "যদি নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন করার আগেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আইন সংশোধন করা হয়, তাহলে তাদের জন্য সবকিছু শিথিল থাকবে। নয়তো পুরনো আইনই বহাল থাকবে।"
কী আছে সুপারিশে
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বলেছে, আইনে দল নিবন্ধনের জন্য যেসব শর্তের কথা হয়েছে, বাস্তবে কোনও দলই সেসব শর্ত মানে না।
অন্যতম প্রধান সুপারিশটি হলো, ১০ শতাংশ জেলা ও পাঁচ শতাংশ উপজেলায় অফিস এবং সারা দেশে সবমিলিয়ে পাঁচ হাজার সদস্য থাকলে নিবন্ধন পেতে পারে।
প্রতি পাঁচ বছর পর পর দল নিবন্ধন নবায়ন বাধ্যতামূলক করা এবং পর পর দু'টি নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন বাতিলের বিধান বাতিল করার কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে গতকাল ২৫শে ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও বলেছেন যে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মাঝেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে যে সময় আছে, তাতে সুপারিশ আমলে নিয়ে আইন সংশোধন করা সম্ভব? জানতে চাইলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, "এখন সংশোধন না, অধ্যাদেশ জারি করবে।"
তিনি বলেন, "কমিশন রাজনৈতিক দলের সাথে সংস্কার নিয়ে বসেছে। যারা ঐক্যমত্য হবে, তারা নির্বাচন কমিশনকে জানাবে। নির্বাচন কমিশন তখন নির্বাচন কমিশন বিধিমালা অধ্যাদেশ করার জন্য খসড়া করে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। আইন মন্ত্রণালয় সেটি দেখে বর্তমান ক্যাবিনেটে পাশ করার জন্য দিবে। এই প্রক্রিয়ায় অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।"
"যেহেতু সংসদ নাই, সেহেতু অধ্যাদেশ জারি করে করতে চাইলে এর মাঝেই করা যাবে।"
এমনিতে আইনে যেসব শর্তের কথা বলা আছে, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে নির্বাচন কমিশন "দেখবে যে অফিস আছে কিনা, থাকলে তা কার্যকর আছে কিনা, গঠনতন্ত্রের সাথে আইনের ফারাক কিনা," বলেন জেসমিন টুলি।
যদি সংবিধান পরিপন্থী কিছু থাকে, তাহলে ওই দলকে তা সংশোধনের জন্য সময় দেওয়া হয়।
সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব আরও জানান, এইসব প্রক্রিয়া শেষ হলে একটি রাজনৈতিক দল সাধারণত দুই থেকে তিন মাসের মাঝে নিবন্ধিত হয়ে যায় এবং প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়।
নতুন দল যেকোনও প্রতীক চাইতেই পারে। তবে আইনগতভাবে, নির্বাচন কমিশন বিধিমালা মেনে সেই প্রতীক বরাদ্দ দেয় নির্বাচন কমিশন।
যাত্রা শুরু করতে যাওয়া এই নতুন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য নেতারা বারবারই বিভিন্ন আলোচনায় বলছেন যে, বাংলাদেশকে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে পরিচয় করাবে এবং তারা পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারার বাইরে গিয়ে রাজনীতি করবে।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব প্রধানত পরিবার কেন্দ্রিক বলে অভিযোগ রয়েছে সমালোচকদের।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে। সেক্ষেত্রে যদি নতুন দল নতুন ধারার রাজনীতির সাথে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় করাতে পারে, তাহলে তারা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও পারে। কারণ এই ধরনের দলের চাহিদা আছে সমাজে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ঘটনা নিয়ে ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বিবিসিকে বলেন, যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল থাকে, তখন এই ধরনের নতুন দলের জন্ম হয়।
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালে যখন মুসলিম থেকে আলাদা হয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করে, "তখন সেটি তরুণদের নেতৃত্বেই হয়েছিলো।"
"যদিও মওলানা ভাসানী ছিলেন ছায়ার মতো। খন্দকার মোশতাক, শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন এরা সব ২৫-৩০ বছর বয়সী ছিল তখন। তারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা দলটি করেছিলেন," বলেন তিনি।
"সংকট বা পালাবদলের সময় শূন্যতা তৈরি হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। মুসলিম লীগ সরকার গঠন করলো। বিরোধী দল বলতে কিছু ছিল না। সেই শূন্যতা পূরণ করে আওয়ামী লীগ। তারা বিরোধী দল হয়েছিলো। ২৩ থেকে ২৪ বছর পর তারা সরকার গঠন করতে পেরেছিলো।"
মি. আহমদ বলেন, ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তরুণরা জাসদ করলো।
"১৯৭২ সালেও শূন্যতা ছিল। তখন ক্ষমতাসীনের বাইরে কোনও বিরোধী দল ছিল না। বিরোধী দল যারা হতে পারতো, তারা আওয়ামী লীগের সাথে একটি কোলাবোরেট করেছিলো। সেই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করে জাসদ," বলেন এই বিশ্লেষক।
সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও জাসদের যাত্রা শুরুর মাঝে এক ধরনের মিল পাওয়া যায়।
"জুলাই অভ্যুত্থানের পর তরুণরা বললো যে আমরা উদ্যোগ নিবো, এটি গণবিদ্রোহের ফলাফল" উল্লেখ করে মি. আহমদ ওই দুই দলের সাথে এই নতুন দলের একটি পার্থক্যের কথা বলেন।
"যদিও তারা (ছাত্ররা) এই সরকারেরই অংশ। কারণ তাদের আন্দোলনের ফলেই এই সরকার এসেছে। সেক্ষেত্রে তাদের এই পদক্ষেপ (আওয়ামী লীগ ও জাসদের মতো) এই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না। তাদের এই বিদ্রোহ বিগত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট থেকে তারা এই ধরনের দল গঠনের কথা ভেবেছে," বলেন তিনি।
দেশভাগের পর এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মতো এই মুহুর্তেও বাংলাদেশে "একই ধরনের একটা শূন্যতা আছে" উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "তারা ঠিকভাবে চলতে পারলে, সংগঠিত হতে পারলে, জনগণের সাথে সংহতি নিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারলে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ছাত্ররা নতুন স্রোত তৈরি করতে ও শূন্যতা পূরণ করতে পারবে।"