শিরোনাম
◈ রাতে পরপর গুলির শব্দ, উদ্ধার হলো ৩ যুবকের মরদেহ ◈ এবার রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৫ ইউনিট ◈ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে এখন ছাত্ররাই কেন সংগঠন তৈরি করছে? ◈ শিবির নেতার ওপর হামলা, ছাত্রদলকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বার্তা ◈ পশ্চিমতীরে তীব্র অভিযানের নির্দেশ নেতানিয়াহুর ◈ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, আফগানিস্তানকে ১০৭ রানে হারালো দক্ষিণ আফ্রিকা ◈ স্ত্রীর সামনে ফিল্মি স্টাইলে যুবদল কর্মীকে কু.পিয়ে হত্যা ◈ সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোয় রেকর্ড হলেও রেমিট্যান্স আয়ে পতন কেন? ◈ কুয়েট উপাচার্যের বাসভবনে তালা দিলেন শিক্ষার্থীরা ◈ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি শায়খ আহমাদুল্লার খোলা চিঠি

প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৪:০৯ সকাল
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০১:২০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বিএসএফ ও বিজিবি-র শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক: একমত হতে পারলো না দেড়শো গজের ইস্যুতে

বৈঠকে দু'পক্ষের নেতৃত্ব দেন বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী (বাঁয়ে) ও বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফউজ্জামান সিদ্দিকি

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমান্তে শূন্যরেখার দেড়শো গজের মধ্যে ভারত কোনও কাঁটাতারের বেড়া বসাতে চাইলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, সেই প্রশ্নে কোনও সার্বিক ঐকমত্য ছাড়াই দিল্লিতে আজ (বৃহস্পতিবার) বিএসএফ ও বিজিবি-র শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক শেষ হয়েছে।

বৈঠকের শেষে এদিন এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বিজিবি-র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফউজ্জামান সিদ্দিকি জানান, কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়েছে এবং তারা প্রস্তাব করেছেন, যে সব জায়গায় বেড়া বসানো নিয়ে 'ইস্যু' তৈরি হবে সেখানে দুই বাহিনীর পক্ষ থেকে 'যৌথ পরিদর্শনে'র ব্যবস্থা করা হোক।

'আগামী দিনে' পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে এই বিরোধের নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে বলেও তিনি আশা ব্যক্ত করেন।

পাশাপাশি সাংবাদিক সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরীর বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট হয়ে গেছে, সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ পুরোপুরি বন্ধ রাখা হবে, এমন কোনও প্রতিশ্রুতি তারা দেননি।

ফলে বলা যেতেই পারে, আগামী দিনে সীমান্তের দেড়শো গজের ভেতরে কোথাও ভারত কাঁটাতারের বেড়া বসাতে গেলে আবার যে সংঘাত তৈরি হবে না, সেই নিশ্চয়তা এই বৈঠক থেকে পাওয়া গেল না।

এদিকে চার দিনব্যাপী এই বৈঠকের (১৭-২০ ফেব্রুয়ারি) শেষে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে অবকাঠামো বসানো বা নির্মাণ কাজ করার বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় উত্থাপন করা হয়েছিল।

কিন্তু বৈঠকে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্তগুলো গৃহীত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, তাতে এই বিষয়টির কোনও উল্লেখ নেই।

তবে সীমান্তে বিএসএফের ওপর সীমান্তের অন্য পার থেকে অপরাধী বা দুষ্কৃতীদের হামলার ঘটনা ঠেকাতে দু'পক্ষই যৌথভাবে কাজ করবে বলে সম্মত হয়েছে। বিশেষ করে গভীর রাতে ও ভোররাতের দিকে সীমান্তে 'সমন্বিত টহলদারি' বাড়ানো হবে বলে স্থির হয়েছে।

দিল্লিতে বিএসএফের একটি শীর্ষস্থানীয় সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিজিবি-র ওপরে ভারতের দিক থেকে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে তারাও সব রকম ব্যবস্থা নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া 'সীমান্তের কোনও দিকে কোনও প্রাণহানি ছাড়াই' কীভাবে কার্যকরী 'বর্ডার ম্যানেজমেন্ট' নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যেও দুই বাহিনী কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়েছে।

এই পটভূমিতে বিএসএফ সীমান্তে তাদের 'প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার' পুরানো নীতিও এদিন পুনর্ব্যক্ত করেছে। যদিও উল্লেখ্য সাম্প্রতিক অতীতেও বারবার সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিহত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

কাঁটাতারের বেড়া ইস্যুতে বিরোধ : গত পাঁচই অগাস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের জেরে শেখ হাসিনার পতনের পর এটিই ছিল বিএসএফ ও বিজিবি-র মহাপরিচালক পর্যায়ের প্রথম বৈঠক।

এমনিতে এই পর্যায়ের বৈঠক প্রতি বছর দু'বার করে হয়ে থাকে – পালা করে একবার ভারতে ও পরের বার বাংলাদেশে। তবে ২০২৪ সালের ৫ থেকে ৯ই মার্চ ঢাকায় শেষ বৈঠকের পর দিল্লিতে এবারের বৈঠক হলো প্রায় বছরখানেক পর।

এর মাঝের কয়েকমাসে সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া বসানোকে কেন্দ্র করে নানা জায়গাতেই বিএসএফ ও বিজিবি-র মধ্যে সংঘাত দেখা দিয়েছে, দু'দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার স্থানীয় গ্রামবাসীরাও তাতে জড়িয়ে পড়েছেন।

এমনকি, এই প্রশ্নে ঢাকায় ও দিল্লিতে দু'দেশের রাষ্ট্রদূতদের পাল্টাপাল্টি তলব করার ঘটনাও ঘটেছে।

বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ছিল, সীমান্তের শূন্যরেখার দেড়শো গজের মধ্যে কোনও প্রতিরক্ষা স্থাপনা বসানো বেআইনি হলেও ভারত তা লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া বসাচ্ছে বলেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

অন্য দিকে ভারতের যুক্তি ছিল, সীমান্তে চোরাকারবার ও মানবপাচারের মতো অপরাধ রুখতেই বেড়া বসানো জরুরি – আর এই বেড়া বসানো হচ্ছে সব দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ও চুক্তি মেনেই।

তবে এরই মাঝে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য গত মাসে জানিয়েছিলেন, বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি জায়গাতে সীমান্তের দেড়শো গজের ভেতরেও ভারতকে বেড়া বসানোর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

তবে সেই অনুমতি বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রত্যাহার করবে কি না, তা তিনি তখন স্পষ্ট করেননি।

বিজিবি ও বিএসএফের অবস্থান:  এই পটভূমিতেই প্রত্যাশিতভাবে বিএসএফ ও বিজিবি-র মহাপরিচালকদের মধ্যে বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

বিজিবি-র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফউজ্জামান সিদ্দিকি বৈঠকের শেষে জানান, এটা ঠিকই যে কয়েকটি জায়গায় বিজিবি কাঁটাতারের বেড়া বসানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

তার কথায়, "সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে স্থায়ী নির্মাণকাজ কখনওই বিজিবি-র সহায়তায় করা হয় না। কিন্তু (দেড়শো গজের ভেতরে) কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ আমরা করে থাকি দু'পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতেই।"

"তবে এখানে কখনও কখনও ভুলবোঝাবুঝি ('মিসকমিউনিকেশন') ঘটে, তখন বিজিবি ভারতের দিকে কাজ নিয়ে আপত্তি তোলে। আবার উল্টোটাও ঘটে। তখন কাজ থামিয়ে আমরা দু'পক্ষ আলোচনা করে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করে থাকি।"

আগামী দিনেও একইভাবে এই ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে বলেও তার কথায় ইঙ্গিত ছিল।

বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী অবশ্য দেড়শো গজের ভেতরে কাঁটাতারের বেড়া বসানো নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

তবে বৈঠকের শেষে বিএসএফের জারি করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সীমান্তে হামলার ঘটনা কমিয়ে আনতে 'ঝুঁকিপ্রবণ' এলাকাগুলোতে দুই বাহিনী নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রেখে টহলদারি চালাবে এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তের 'মর্যাদা' রক্ষার বিষয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের সচেতন করে তোলার কাজ চালাবে।

১৯৭৫ সালের যে দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত চুক্তিতে দেড়শো গজের মধ্যে স্থাপনা তৈরির বিধিনিষেধ উল্লিখিত আছে, সেই চুক্তি পর্যালোচনা করা নিয়ে অবশ্য দিল্লির বৈঠকে কোনও আলোচনা হয়নি।

"ওটা আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরের বিষয় ছিল", জানান বিজিবি-র মহাপরিচালক।

অনুপ্রবেশ ও সীমান্ত হত্যার ইস্যু : গত অগাস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতে 'অনুপ্রবেশে'র ঘটনা যে বাড়েনি, এটা আজ দুই বাহিনীর পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয়েছে।

বিজিবি-র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফউজ্জামান সিদ্দিকি বলেন, "হয়তো এরকম একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে অনুপ্রবেশ বেড়েছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়ে এদিকে চলে আসতে চাইছেন। অনেক অতিরঞ্জিত মিডিয়া রিপোর্টও হয়েছে এরকম।"

"কিন্তু অনুপ্রবেশ মোটেই বাড়েনি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে হয়তো আক্রান্ত হওয়ার একটা ভয় ছিল, কিন্তু আমরা তাদের সেই ভয় ভাঙিয়েছি। আমরা তাদের বুঝিয়েছি যে তাদের দেশ ছাড়ার কোনও প্রয়োজনই নেই", জানান তিনি।

৫ই অগাস্টের পর থেকে অনুপ্রবেশ যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণেই আছে, সে কথা মেনে নেন বিএসএফ মহাপরিচালকও।

সাংবাদিক সম্মেলনে দলজিৎ সিং চৌধুরী বলেন, "গত পাঁচ অগাস্টের পর থেকেই সীমান্তের দুই দিকে দুই পক্ষই শান্তিপূর্ণভাবে মোতায়েন আছে, যাতে কোনও ধরনের অনুপ্রবেশ না ঘটে বা তাতে রাশ টানা যায়।"

সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রাণহানির ইস্যুটিও বিজিবি-র পক্ষ থেকে বৈঠকে প্রতিবারের মতোই তোলা হয়েছিল।

এর জবাবে বিএসএফের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, সীমান্তের কোনও দিকে কোনও প্রাণহানি ছাড়াই যাতে 'কার্যকরী বর্ডার ম্যানেজমেন্ট' নিশ্চিত করা যায়, এটাই তাদের লক্ষ্য থাকবে।

সীমান্তে যৌথ টহলদারি ও পাহারা বাড়িয়ে, জনসচেতনতা কর্মসূচি চালিয়ে, সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধরনের আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে এবং দুই বাহিনীর মধ্যে 'রিয়েল-টাইম' তথ্য বিনিময়ের মাধ্যেমই সেটা করা যেতে পারে বলে বিএসএফের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের 'নন-লিথাল পলিসি'তেও কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না বলে জানিয়েছে তারা।

সহজ কথায় এই নীতিটা হল, সীমান্তে প্রহরারত বিএসএফ সদস্যরা যদি আক্রান্ত হন, তখনই কেবল আত্মরক্ষার্থে তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবেন – নইলে কখনওই তারা 'লিথাল' বা প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করবেন না।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে চালু করা এই নীতি অবশ্য বিএসএফ বারে বারেই লঙ্ঘন করে চলেছে বলে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে।

বিএসএফ ও বিজিবি-র মহাপরিচালক পর্যায়ের পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় চলতি বছরের জুলাই মাস নাগাদ অনুষ্ঠিত হবে বলেও এদিন জানানো হয়েছে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়