শিরোনাম
◈ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিক্ষোভকারীদের দমাতে ‘প্রাণঘাতি বলপ্রয়োগের’ নির্দেশ দেয় সরকার : জাতিসংঘের প্রতিবেদন ◈ এটা বীভৎস দৃশ্য, গ্রামের মুরগির খাঁচাও এর থেকে বড় হয়: প্রধান উপদেষ্টা (ভিডিও) ◈ আমি কি সেটা আমি সাত দিন পর দেখাব, বিপ্লবী ছাত্র-জনতা আমার সঙ্গে রয়েছে : কাফি (ভিডিও) ◈ ডিজিএফআইয়ের সেই দুই টর্চারসেল চিনতে পারার কথা জানিয়েছেন উপদেষ্টা নাহিদ-আসিফ ◈ এ বছর ভালোবাসা দিবসে ‘তামাশা’ না করার আহ্বান মৎস্য উপদেষ্টার! ◈ আয়না ঘর দেখতে গেলেন প্রধান উপদেষ্টা ◈ যুক্তরাষ্ট্রে অনাগত সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হাজারো ভারতীয় অভিবাসীরা ◈ গরুর লাম্পি স্কিন টিকা আবিষ্কার হলো দেশেই, খরচ ৭০ টাকা ◈ নির্বাচনে যে আসন থেকে লড়তে পারেন হাসনাত-সারজিসসহ অন্যরা ◈ দুবাইয়ে থাকা সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছেন বাংলাদেশীরা!

প্রকাশিত : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১:২৮ দুপুর
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৪:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কিশোরীদের জন্য ‘প্রেমের ফাঁদ’ ফেসবুক-টিকটকে

কিশোরী সন্তান আছে—এমন মা–বাবার জন্য পরপর দুটি ঘটনা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কী করলে সন্তান সুরক্ষিত থাকবে, কী বললে সন্তান নিজেকে নিরাপদ রাখার বিষয়টি বুঝতে পারবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা।

সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার একটি হলো নিখোঁজের ১৭ দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার। অপরটি হলো রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ১১ বছর বয়সী এক কিশোরীর ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনা।

অনেকে আতঙ্কিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে দ্বিতীয় কিশোরীও প্রথম কিশোরীর মতো ভয়াবহতার শিকার হলো কি না। তবে সৌভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় কিশোরী জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েটি ও তার পরিবারের প্রতি যেভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের ছড়াছড়ি হয়েছিল, ন্যূনতম নীতি–নৈতিকতা ও আইন অনুসরণ না করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছিল, তা অভিভাবকদের মধ্যে সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয় আরও বাড়িয়ে দেয়।

শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইমোর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানকারী অ্যাপের মাধ্যমে খুব সহজে কিশোরীদের জন্য ‘প্রেমের ফাঁদ’ পাতছে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা। বয়স কম থাকায় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বুঝতে না পারা, নিজেদের বিবেচনাবোধ ব্যবহার করার মতো দক্ষতা না থাকা, আবেগপ্রবণ হওয়ায় কিশোরীরা সহজেই এসব ফাঁদে পা দিচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।

এই বিপদ থেকে বাঁচতে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টি, নির্দিষ্ট বয়সের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে না দেওয়া, অভিভাবকদের সন্তানদের সময় দেওয়া ও নজরে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার দুই ব্যক্তি বলেন, হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে পাঁচজন মিলে ধর্ষণ করলে কিশোরীর মৃত্যু হয়।

গ্রেপ্তার দুজনের একজন গাড়িচালক রবিন। তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয় থেকে ওই কিশোরীকে মহাখালীর একটি বাসায় ডেকে নেন তিনি। পরে কিশোরীর লাশ বস্তাবন্দী করে একটি রিকশায় নিয়ে হাতিরঝিলে ফেলা হয়।

এই কিশোরী গত ১৬ জানুয়ারি দোকানে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।

অন্যদিকে মোহাম্মদপুর থেকে ১১ বছর বয়সী মেয়েটি তার চেয়ে ১১ বছরের বড় এক তরুণের সঙ্গে চলে যায় ঢাকার বাইরে।

এই কিশোরী উদ্ধারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল লোক মেয়েটির বয়স বিবেচনায় না নিয়ে যথেচ্ছ ভাষায় তাকে আক্রমণ করে। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটির অগ্রহণযোগ্য আচরণ নিয়ে সবাই চুপ ছিল।

ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার জন্য মেয়েটিসহ পরিবার ঢাকায় এসেছিল। পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে মেয়েটি বলেছিল, ‘বাসায় ভাল্লাগে না, তাই চলে আসছি।’

সমাজবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী কিশোরীদের এ ক্ষেত্রে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। পরিবেশ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অবাধ গণমাধ্যম এর জন্য দায়ী। ষাট ও সত্তরের দশকের সামাজিক মূল্যবোধ এখন কাজ করছে না। আধুনিকতা, শিল্পায়ন, পেশা নিয়ে ব্যস্ততা, গণমাধ্যমের অবাধ ব্যবহার সমাজে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। এই সমস্যাগুলো নতুন নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় থেকে বাড়িপালানো
ঘটনা-১: সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা অবস্থায় এক শিশুর মা–বাবা দুর্ঘটনার শিকার হন। খুব রহস্যজনকভাবে বাবার খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। তিনি মৃত, নাকি জীবিত, জানেন না পরিবারের সদস্যরা।

শিশুটির বয়স তখন মাত্র এক বছর ছিল। সৌভাগ্যক্রমে সে দুর্ঘটনার সময় মা–বাবার সঙ্গে ছিল না। সংকটাপন্ন অবস্থায় মা দেড় মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

ঘটনাটি ১০ বছর আগের। মেয়েটির বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর মেয়েটি তার নানির কাছে থাকে। সে সময় এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা মেয়েটিকে রাজধানী ঢাকায় নিজের বাড়িতে এনে সন্তানদের সঙ্গে লালন-পালন করতে থাকেন।

ধানমন্ডির একটি স্কুলে মেয়েটি পড়ত। মেয়েটির বয়স এখন ১১ বছর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ৫–৬ দিনের পরিচয়ে মেয়েটি ২১ থেকে ২২ বছর বয়সী এক তরুণের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ওই তরুণ মেয়েটিকে প্রথম টঙ্গী, পরে দিনাজপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে রাখেন। ঘটনার এক দিন পর মেয়েটিকে দিনাজপুর থেকে উদ্ধার করা হয়।

সরকারি কর্মকর্তার পরিবার এখন মেয়েটিকে বাড়িতে রাখার সাহস পাচ্ছে না। পরিবারটির সদস্যরা মনে করছেন, এরপর যদি মেয়েটি আবার পালায়, তাহলে তাঁরা তার মা ও নানিকে কী জবাব দেবেন? তবে তাঁরা মেয়েটির প্রতি সহানুভূতিশীল। মেয়েটির জন্য কিছু একটা করতে চান। মেয়েটি এখন আছে বরিশালে নানির কাছে।

ঘটনা-২: এই কিশোরীর বয়সও ১১ বছর। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। সীমান্তবর্তী একটি জেলার মেয়ে সে। টিকটকের মাধ্যমে তার পরিচয় হয় গাজীপুরের এক তরুণের সঙ্গে। পরে তারা নিয়মিত ইমোতে কথা বলতে শুরু করে।

একদিন মেয়েটি স্কুলের বান্ধবীদের বলে, সে ছেলেটির সঙ্গে চলে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটা মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যায়। একই সঙ্গে এটাও বলে যায়, ‘আমার আব্বু-আম্মুকে কিন্তু এই নম্বর দিস না।’

ঘটনার দুই দিন পর মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, ওই তরুণ টিকটকের জন্য বিভিন্ন ভিডিও বানান। এ জন্য বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে এভাবে সম্পর্কে জড়ান।

ঘটনা-৩: ঘটনাটি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের। অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ের সঙ্গে টিকটকে ২৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী এক টিকটকার ছেলের পরিচয় হয়। ছেলেটি বিবাহিত। এ ‘সম্পর্কের টানে’ মেয়েটি বাড়ি থেকে পালায়। পরিবার মেয়েটির নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনি সহায়তা নেয়। মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। মেয়েটি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

উল্লিখিত তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রেই অভিভাবকেরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড হেল্পলাইন নম্বরে (১০৯৮) সহায়তা চেয়েছিলেন। তিন কিশোরীকেই মনঃসামাজিক সহায়তা দিচ্ছেন হেল্পলাইনের কাউন্সেলররা। তৃতীয় কিশোরীর ক্ষেত্রে টিকটকার তরুণকেও যুক্ত করা হয়েছে পুরো প্রক্রিয়ায়। তরুণটিকে বোঝানো হয়েছে যে মেয়েটিকে সাহায্য করার দায়িত্ব তাঁরও রয়েছে। তিনি যেন মেয়েটিকে পড়াশোনা ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে উদ্বুদ্ধ করেন।

চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, হেল্পলাইনে যত বিষয়ে সহায়তা চেয়ে কল আসে, তার মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হলো এই সাইবার-সংক্রান্ত বিষয়। ভুক্তভোগী কিশোরীদের অভিভাবকেরা ভয়ানক অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মা বলেন, তাঁর দুই কিশোরী সন্তান আছে। পড়াশোনা ও বিনোদনের জন্য বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ আছে। তিনি সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার পছন্দ করেন না। তবে তিনি অনলাইনের বিষয়গুলো কম বোঝেন বলে ভালোভাবে নজরদারি করতে পারেন না। চারপাশের ঘটনায় তিনি মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেন চাইল্ড হেল্পলাইনের প্যারা কাউন্সিলর তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, আবেগীয় সম্পর্ক থেকে কিশোরীরা পরিণতি না ভেবেই বাড়ি ছাড়ে। অনেক পরিবারে মা–বাবার সঙ্গে সন্তানের ততটা সখ্য নেই। মা–বাবা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সন্তানের অ্যাকাউন্ট আছে কি না, তা–ও তাঁরা জানেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটনা কতখানি গুরুতর হতে পারে, তা তাঁরা বুঝতে পারেন না। আবার অনেক মা–বাবা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁরা অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বললেও সন্তানেরা শোনে না।

করণীয় কী: চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন বলেন, সুরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার না করলে কী কী বিপদ হতে পারে, সে সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার দরকার। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অনেক অভিভাবক নিজেও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, সন্তানদেরও সেভাবে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। কোন বয়সে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়ে নীতিমালা করা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলো এখন এদিকে নজর দিচ্ছে। ভুক্তভোগীদের সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে চাইল্ড হেল্পলাইন।

স্কুলশিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনা উচিত বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের। বেশ কিছু বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান এই দেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও শিশুদের উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খায় না। সেসব চ্যানেলের সম্প্রচার এ দেশে বন্ধ করা উচিত।’ উৎস: প্রথম আলো।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়