চিকিৎসার জন্যে বাংলাদেশিদের ভারত যাত্রা অর্ধেকে নেমেছে। অসুস্থ বাংলাদেশিদের উন্নত চিকিৎসার জন্যে ভারতমুখী যাত্রা ৬ মাসের ব্যবধানে ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার ভারতমুখী প্রবাহেও ভাটা পড়েছে। তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য ও উন্নত চিকিৎসার প্রত্যাশায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫ লাখ বাংলাদেশি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছিল। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে পরিবর্তিত এ চিত্রকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করেছে ভারত সরকার। সম্প্রতি ভারতের আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে অবনতি ঘটে। একপর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিসা সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। সীমিত পরিসরে চিকিৎসা ভিসা পাওয়া গেলেও তা হাতেগোনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে ও বিভিন্ন সংস্থার ভিসা প্রসেসিং সংস্থার মাধ্যমে অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর সীমিতসংখ্যক ভিসা মিলছে। কেউ কেউ নানা চেষ্টার পর পেলেও অধিকাংশই পাচ্ছেন না। ফলে আপাতত দেশের চিকিৎসায় নির্ভর করতে হচ্ছে রোগীদের। ভিসা জটিলতায় বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় শেষ ছয় মাসে ভারতগামী রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি, অন্যদিকে বেসরকারিতে ন্যূনতম সেবার পরিবর্তে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেকটা ‘খদ্দের’ মনে করেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসক ও কর্মীদের চেষ্টাই থাকে রোগীকে কৌশলে বেসরকারি হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে বাড়তি পয়সা কামানো। এ ছাড়া কমিশনের লোভে অহেতুক পরীক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ ফল, রোগীর কথা না শোনার অভিযোগ তো আছেই। এসব কারণেই দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছেন বহু মানুষ।
তবে এ অবস্থার পরিবর্তনের এখনই সময় বলছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। বিগত সরকারগুলো চিকিৎসায় অবকাঠামোগত উন্নতি করলেও দেশের জনগণের তুলনায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানসম্মত চিকিৎসার চেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই ছিল সরকারগুলোর লক্ষ্য। আশা জাগাতে পারেনি বেসরকারি চিকিৎসা খাতও। বেশকিছু ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেখানেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। যেসব দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত প্রযুক্তির ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বসছেন তারা। প্রয়োজনে সেসব দেশের প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির প্রথম ধাপে পৌঁছাতে চায় সরকার। তবে এজন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জরুরি বলে জানিয়েছেন তারা।
পাঁচ মাসে অর্ধেকে নেমেছে ভারতগামী রোগী : ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যমতে, বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের প্রধান গন্তব্য হলো ভারত, যা প্রায় ৪১ শতাংশ, যার ৮০ ভাগই চিকিৎসার জন্য। এসব যাত্রীদের বড় একটি অংশ যায় সড়কপথে ও ট্রেনে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যায় যশোরের বেনাপোল বন্দর হয়ে। গত বছর এই পথে ৯ লাখ ৫৬ হাজার বাংলাদেশি ভারতে গেছেন। এর মধ্যে চিকিৎসার জন্যই সাড়ে ৭ লাখের বেশি।
বেনাপোল ইমিগ্রেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪০৪ জন বাংলাদেশি ভারতে গেছেন। যা গত বছরের চেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কম। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে চার লাখ ৬১ হাজার বাংলাদেশি ভারতে গেলেও পরবর্তী সময়ে প্রায় ছয় মাসে এই সংখ্যা ৩ লাখের মতো।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইব্রাহিম আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে মূলত যাত্রী সংখ্যা কমে এসেছে। ব্যবসায়ীদের অধিকাংশেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। রোগীর সংখ্যাও এখন অনেক কম।’
অন্যদিকে আখাউড়া স্থলবন্দরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে এই পথ ব্যবহার করে দেড় লাখ বাংলাদেশি ভারতে গেলেও এ বছর এই সংখ্যা ১ লাখের মতো। বিশেষ করে গত ছয় মাসে উল্লেখযোগ্য হারে যাত্রী সংখ্যা কমে এসেছে। যেখানে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গেছেন ৬৭ হাজার, সেখানে পরের পাঁচ মাসে তা ৪০ হাজারের ঘরে।
যাত্রী কমেছে আকাশ পথেও। যদিও ঠিক কতটা কমেছে তার সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে দ্য ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতগামী বিমানের ট্রিপগুলোতে যাত্রীর চাপ প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
ভারতগামীদের ৮০ ভাগই রোগী : বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে প্রতিবছর কত রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ঢাকায় ভারতীয় ভিসা সেন্টারে প্রতিদিন কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ত। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মানুষের ৮০ শতাংশই চিকিৎসা ভিসার প্রার্থী। বর্তমানে যা প্রায় বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ১৫টি ভারতীয় ভিসা অ্যাপলিকেশন সেন্টার পরিচালনা করে থাকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। সেন্টার ও ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনগুলো ২০১৭ সালে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ভিসা, ২০১৮ সালে ১৪ লাখ ৬০ হাজার ভিসা এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৬ লাখ ভিসা দিয়েছে। এসব ভিসার অন্তত তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসার জন্য রোগী ও তাদের সাহায্যকারীদের দেওয়া হয়েছে বলে হাইকমিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর ভিসা প্রদান অনেকটা বন্ধ রেখেছে ভারত সরকার। যার সুযোগ নিচ্ছে থাইল্যাল্ডের হাসপাতালগুলো। দেশটির কয়েকটি হাসপাতালের ঢাকায় নিয়োজিত প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে অন্তত ৩ হাজার রোগী যেত বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে, যা এখন দ্বিগুণের বেশি। এ ছাড়া ব্যাংকক ও ভেজথানি হাসপাতালেও বেড়েছে বাংলাদেশি রোগীদের ভিড়। প্রতিবছর প্রায় সোয়া লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা নিতে যায় দেশটিতে। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবে আহতদের বড় একটি অংশ চিকিৎসা নিচ্ছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে।
যে কারণে যায় : প্রায় তিন বছর ধরে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মো. বেলাল হোসেন (৬৭)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)সহ সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে চেষ্টার পরও লিভার প্রতিস্থাপন করতে চেয়েও পারেননি। বাঁচতে হলে লিভার প্রতিস্থাপনের বিকল্প ছিল না তার। কিন্তু দাতার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছিল বেলালের। গত মার্চে ভারতের চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে বাবাকে লিভার দিয়েছেন ছেলে জাকির হাসান।
আমার দেশকে জাকির জানান, ‘দেশে এত বড় বড় হাসপাতাল, কিন্তু লিভার প্রতিস্থাপনের সক্ষমতা নেই। আমরা সবখানে চেষ্টা করেছি। কিন্তু উপায় না পেয়ে দেশের বাইরে যেতে হয়েছে। যেখানে খরচ লেগেছে ৮৫ লাখ টাকা। অথচ দেশে সক্ষমতা থাকলে এখানেই করা যেত।’
তিনি বলেন, ‘সক্ষমতার পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসক ও নার্সদের সেবায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। টাকা দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কিনতেও এখানে নানা ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হয়। আন্তরিকতার বড় অভাব এখানে। ফলে বিদেশে যেতে একরকম বাধ্য হয় মানুষ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ আমার দেশকে বলেন, ‘মূল সমস্যা আমাদের সিস্টেমে। কোন রোগের চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে সেই তথ্য রোগীর কাছে থাকে না। উন্নত বিশ্বে অসুস্থ হলে প্রথম যে সেন্টারে যায়, সেখান থেকেই বলে দেয় পরবর্তী ধাপে তাকে কোথায় যেতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে রোগী শুরুতে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যায়, পরে এমবিবিএস চিকিৎসকের কাছে। সেখানে নানাভাবে ঘুরে জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিক্যালে। সেখানে আবার দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালো চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছে না। এতে করে অর্থ ও শরীর দুটোই শেষ হচ্ছে। এমন ভোগান্তির পর রোগী নাজেহাল হয়ে বিদেশে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না চিকিৎসকেরা, অন্যদিকে বেসরকারিতে নিজে থেকেই আন্তরিকতা দেখান না তারা। একই সঙ্গে রোগ নির্ণয়েও বড় সমস্যা এখানে। কেউই বলতে পারেন না কোথায় শতভাগ মানসম্পন্ন ডায়াগনোসিস হয়। এসব সমস্যার কারণে মানুষের কাছে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসা হয় না। আর এটাকে লুফে নিচ্ছে বাংলাদেশে থাকা অন্য দেশের দালাল চক্র, ভাগিয়ে নিচ্ছে রোগী।’
আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমরাও সুন্দর একটা মেডিক্যাল ট্যুরিজম করতে পারতাম। বেসরকারি অনেক হাসপাতাল আছে, সেগুলো চাইলেই করতে পারত। কিন্তু এর জন্য দরকার শুধু আন্তরিকতা। বিদেশে চিকিৎসা নিতে গেলে হাসপাতালের ভবনেই থাকা-খাওয়ার সিস্টেম থাকে। কিন্তু স্কয়ার ও ইউনাইটেডের মতো হাসপাতালেও এমন ব্যবস্থা নেই। ফলে দেশের এক প্রান্ত থেকে কেউ চিকিৎসা নিতে ঢাকায় গেলে রোগীর স্বজন জানে না সে কোথায় থাকবে। অথচ মেডিক্যাল ট্যুরিজম মানে শুধু চিকিৎসা নয়। আমাদের সর্বোচ্চ মানের বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঘোষণা দিতে পারে, যেসব রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছে এবং নিতে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের আমন্ত্রণ জানানো যে, আসুন আমরা শতভাগ উন্নত মানের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দেব। তাদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে। যেখানে আলাদা নিরাপত্তা, সময় ও আন্তরিকতা দিয়ে চিকিৎসা, বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। এটি করা গেলে বিদেশমুখী রোগীরা চিকিৎসা নেবে। একবার সেটি দেওয়া গেলে এমনিতেই বাইরে যাওয়ার আগ্রহ কমে যাবে।’
বিদেশে চিকিৎসায় বছরে খরচ ৫ বিলিয়ন ডলার : এই যে এত বিপুল পরিমাণ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, তার ব্যয় কত হবে? একটা হিসাব দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসার জন্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদেশগামী রোগীর বড় অংশই যায় ভারত ও থাইল্যান্ডে। কারণ, এসব দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় উন্নত। তবে, এই খরচের বড় অংশ অনানুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়, যা দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ওপর যথেষ্ট চাপ তৈরি করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশগামীদের এই প্রবণতা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও বিশেষায়িত চিকিৎসার অভাবের দিকটি স্পষ্ট করছে।’
এমতাবস্থায় জোরালো হচ্ছে দেশে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি। গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সরকারি হাসপাতালে অনেক অবকাঠামো হলেও চিকিৎসা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, প্রযুক্তি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, গবেষণা খুব একটা বাড়েনি।
উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, চ্যালেঞ্জ ধারাবাহিকতা : বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমানের ভাষ্যে। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘প্রথমতো যেসব রোগের চিকিৎসা হয় না কিংবা সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই সেসব রোগীরা দেশের বাইরে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্যানসার, ইনফার্টিলিটি, লিভার, কিডনি প্রতিস্থাপন ও কিছু হৃদরোগের রোগী। এসব রোগের চিকিৎসায় কোনোটির টেকনোলজি নেই, আবার কোনোটির সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া বড় সমস্যা আস্থার সংকট। এগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে খুব অল্প সময়ে এগুলোর উন্নতি সম্ভব নয়।’
সায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিদেশমুখীতা কমাতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সবকিছু রাতারাতি হবে না। যন্ত্রপাতি আনতে পারলেও সেই ধরনের দক্ষ লোকবল লাগবে। উত্তোরণে জরুরি জাতীয় উদ্যোগ। যে জায়গাগুলোতে সংকট, ঘাটতি ও সমস্যা রয়েছে, সেখানে আমরা হাত দেব। তবে সবকিছু শতভাগ করে দেওয়া কঠিন। যেগুলোতে অবকাঠামো আছে, সেখানে উন্নত সেবা চালু করতেও অন্তত এক থেকে দেড় বছর লাগবে।’
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া পরিবর্তন কতটা সম্ভব?- এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী বলেন, ‘ধারাবাহিকতা ছাড়া সম্ভব নয়। তবে আমরা শুরু করে দিয়ে যেতে চাই। এরই মধ্যে সরকার-বেসরকারি সব নীতিনির্ধারকদের নিয়ে বসা হয়েছে। এক্ষেত্রে টেকনোলজি ট্রান্সফার করা যায়, এমন দেশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা অগ্রসর এমন দেশের সঙ্গের আলোচনা চলছে।’
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে সমাধান : রোগীদের বিদেশ যাওয়াকে স্বাস্থ্য খাতের রোগের উপসর্গ বলে উল্লেখ করেছেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহিনুল আলম। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘মূল অসুখটা হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোজিস্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীর গুরুতর সংকট। এসব লোকবল বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বিপৎসীমার চেয়েও কম মাত্রায়, বাংলাদেশ তার একটি। সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসক দিয়েও ১৭ কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। বরাদ্দও অনেক কম। এছাড়া সব জায়গায় অনিয়ম, দুর্নীতিতো রয়েছেই। পাশাপাশি দক্ষতা অনুযায়ী পদোন্নতি হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নেই। বিদেশমুখীতা কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, পরবর্তী সরকার যদি সেগুলোর ধারাবাহিকতা না রাখে, আবারও অবস্থাপনা থেকে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘সমস্যা সরকারি-বেসরকারি অংশীদ্বারত্বে হাসপাতাল তৈরি করলে বড় সুফল মিলবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিত্তবানরা টাটা ম্যামোরিয়াল, সিএমসি ভেলরের মতো এমন হাসপাতাল করেছে। অনেক মানুষের দানের মাধ্যমে এগুলোতে কম খরচে সর্বোচ্চ উন্নতমানের চিকিৎসা পাওয়া যায়।’
অধ্যাপক শাহিনুল বলেন, ‘জনবলকে কাজে লাগাতে পারাটাও বড় গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে বেসিক ধরে উপজেলা হাসপাতালকে প্রাথমিক চিকিৎসা, জেলা হাসপাতালকে বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রদান কেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে একাডেমিক গবেষণা- এই স্তর বিন্যাসকে রেফারেল সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারলে কম জনবল দিয়ে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। ফলে ঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ফেলে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।’ উৎস: দৈনিক আমার দেশে।
আপনার মতামত লিখুন :