ফাইনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন : ড. ইউনূস বলেছেন, বিদ্যুৎ, পানি এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে দিল্লির সমর্থনের অভাব রয়েছে। তিনি নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে স্বাগতম জানিয়েছেন। দুই প্রতিবেশীর যেমন সম্পর্ক থাকা উচিত তা সর্বোত্তম পন্থায় থাকতে হবে বলে মনে করেন ইউনূস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন ড. ইউনূস।
‘ফ্যাসিবাদের সকল বৈশিষ্ট্য’ প্রদর্শনের জন্য ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী নেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অভিযুক্ত করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, দেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো স্থান নেই।
ড. ইউনূস ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার 'কিছু ঘটনা' ঘটেছে এবং 'খুব অল্প সংখ্যক' প্রাণহানি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, তাদেরকে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে।
জুলাই-আগস্ট ছাত্রজনতা নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানের পর যখন হাসিনার পতন হয়েছে তখন বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন ৮৪ বছর বয়সী শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস।
তিনি আরও বলেছেন, এখনই তার সরকার ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে দিল্লির কাছে ফেরত চাইবে না। কেননা এ বিষয়টি প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ড. ইউনূস বলেছেন, নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদে তার কোনো জায়গা হবে না, তার দল আওয়ামী লীগেরও কোনো জায়গা হবে না। কেননা তারা দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক কলকব্জা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারা নিজেদের সুবিধার জন্য রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে। সুতরাং তাদের মতো কোনো ‘ফ্যাসিস্ট দল’ গণতান্ত্রিক ধারায় স্থান পাবে না।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের আমলে হওয়া নির্বাচনে কারচুপি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখলের অভিযোগ এনেছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার দলকে রাজনীতি থেকে সাময়িক নিষিদ্ধের আলোচনাও শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, রাজনীতিতে ফিরতে হলে আওয়ামী লীগকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। আবার কারো কারে মতামত হচ্ছে ওই দলটিকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা উচিত। এ নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে।
ড. ইউনূসের ধারণা আওয়ামী লীগ ভেঙে যেতে পারে। তবে তিনি এ বিষয়েও জোর দিয়েছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হাসিনার দলের কোনো ভাগ্য বদল হবে না। কেননা তারা কোনো বর্তমান সরকার ‘রাজনৈতিক সরকার নয়’। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি-না তা নির্ধারিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ঐক্যমতের’ ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে তা নির্ধারণ করতে হবে।
ভারতে হাসিনা কোথায় আছেন সে অবস্থান এখনও নিশ্চিত নয়। সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, তাদের দল যে কোনো সময় নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতায় থাকাকালীন ড. ইউনূসকে টার্গেট করেছিলেন হাসিনা। এতে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে দুইজন ছাত্রনেতা রয়েছেন। বাংলাদেশে নতুন নির্বাচনের পথ তৈরি করার পাশাপাশি পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং জনপ্রশাসনসহ সংস্কারমূলক কাজের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করেছে ড. ইউনূস সরকার।
ইতিমধ্যেই কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ড. ইউনূস। এছাড়া তার কোনো রাজনৈতিক দল গঠনেরও ইচ্ছা নেই। তিনি বলেছেন, আমাদের কাজ হচ্ছে সংস্কার এজেন্ডাগুলো নিষ্পত্তি করা। নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসব আমরা।
শেখ হাসিনার শাসনের পতনের ফলে তার সবচেয়ে বড় বিদেশি সমর্থক ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। হাসিনাসহ তার দলের ৪৫ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই আদালতের রায় ঘোষণার পরই ভারতের সঙ্গে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলাপ শুরু করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ড. ইউনূস বলেন, হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলার রায় ঘোষণার পর ভারতের সঙ্গে প্রত্যার্পণ চুক্তির আওতায় তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আমি মনে করি না যে, রায় হওয়ার আগে এটা করার দরকার আছে।
আগস্টে হাসিনা পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, বিক্ষোভ দমনে তার মায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার যেসকল অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা। হাসিনা পুত্রের দাবি, যেহেতু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা নেই তাই যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছেন তিনি।
হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর তার দলের অনেক নেতা-কর্মী দেশ ছেড়েছেন অথবা আত্মগোপনে রয়েছেন। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী হত্যার অভিযোগ উঠেছে। তবে এর সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ড. ইউনূসের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে, হিন্দুদের ওপর ব্যাপক নৃশংসতা নিয়ে ভারত যে অভিযোগ করছে তার কোনো সত্যতা নিশ্চিত করেনি মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
আপনার মতামত লিখুন :