শিরোনাম
◈ পলাতক পুলিশ সদস্যদের বেতন বন্ধ, হচ্ছে মামলা, বেশির ভাগই ভারতে অবস্থান করছেন ◈ আওয়ামী লীগ এখনই নিষিদ্ধ নয়, তবে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে : উপদেষ্টা নাহিদ ◈ ক্ষমতার ভারসাম্য, একজন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় : বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব ◈ ড. ইউনূসকে নিয়ে ১০ বছর আগে যা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি ◈ জামায়াত কাদের সঙ্গে জোট করবে, জানালেন সেক্রেটারি গোলাম পরোয়ার ◈ ৫৩ বছর দেখেছি, আমরা আরও দু-এক বছর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে দেখতে চাই:  নুরুল হক (ভিডিও) ◈ নবীনগরে বিপনী মার্কেটে আগুন, পুড়ে ছাই ১২ দোকান ◈ ‘ওরেশনিক’ রাশিয়ার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যা জানা গেল ◈ ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক ◈ মাগুরায় উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার

প্রকাশিত : ২৩ অক্টোবর, ২০২৪, ০৬:১০ বিকাল
আপডেট : ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিরা অতীতে কে কীভাবে বিদায় নিয়েছিলেন?

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন: বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গভবনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনাপ্রবাহ দেখা যায় ইতিহাসে। দেশে এখন পর্যন্ত যত রাষ্ট্রপতি এসেছেন তাদের মধ্যে অনেকের বিদায় সুখকর হয়নি।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে- কেউ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, কেউ রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেক সময় রাষ্ট্রপতির সাথে ক্ষমতাসীন দলের মানসিক দূরত্ব তৈরির কারণে তাদের পদ ছেড়ে যেতে হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রপতি ছিলেন তাদের বিদায় কীভাবে হয়েছিল? 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে যে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছিল সেখানে রাষ্ট্রপতি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন সেজন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে আসার পর শেখ মুজিবুর প্রধানমন্ত্রী হন এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে।

আবু সাঈদ চৌধুরী : আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।

তখন শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদে থাকার সময় নানা বিষয় নিয়ে আবু সাঈদ চৌধুরীর মধ্যে মনোবেদনা তৈরি হয়। এসব মনোবেদনার কথা রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন তাকে অবহেলায় রাখা হয়েছে এবং তিনি দেশের কোনো কাজে লাগছেন না।
তাছাড়া বঙ্গভবনে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
তখন বঙ্গভবনে কর্মরত ছিলেন মাহবুব তালুকদার, যিনি পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। বঙ্গভবনের নানা ঘটনা নিয়ে মাহবুব তালুকদার ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সে বইয়ে মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, ‘প্রথম দিকে কয়েকজন মন্ত্রী তার সাথে দেখা করতে আসলেও কালক্রমে দেখা গেল প্রায় সবাই ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিহার করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি স্বভাবতই আশা করেছিলেন মন্ত্রীরা নিয়মানুযায়ী তার সঙ্গে মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ করে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের বিষয় ও সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা করবেন।

’এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার নানা ইস্যু এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নানা সিদ্ধান্ত পছন্দ করেননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আর কিছুদিন গেলেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার মানসিক দুরত্ব জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে যেতো।

মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন ঠিকই, কিন্তু শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর গণতন্ত্রের মূলধারা থেকে অনেক সরে আসেন। এটাও রাষ্ট্রপতির জন্য সহজে গ্রহণীয় ছিল না। অনেকদিন তিনি আমাকে বলেন, “গণতন্ত্র ও জাতির জনকের মধ্যে বিরোধ দেখা দিচ্ছে”।  আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অনেক সময় বিব্রতকর মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে বলে আমার ধারণা।’

এমন প্রেক্ষাপটে  ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

মুহম্মদুল্লাহ : আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি করা হয় মুহম্মদুল্লাহকে। তিনি ছিলেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার। মাহবুব তালুকদারের মতে ব্যক্তিত্বের দিক থেকে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং মুহম্মদুল্লাহর মধ্যে অনেক ফাঁরাক ছিল। তাকে নিয়ে সরকারের সাথে কখনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ নিজেও এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেন না।

তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহর বঙ্গভবনে অধিষ্ঠান বঙ্গবন্ধুকে স্বস্তি ও আরাম দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। নতুন রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহকে যা কিছু বলা হতো, তিনি তা করতেন।’

রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহকে খুব একটা মূল্যায়ন করা হতো না। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন না। এ রকম একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন মাহবুব তালুকদার। ১৯৭৫ সালের ৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির কর্মসূচি অনুযায়ী নেপালের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসার কথা। এজন্য রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ নিজেও তৈরি ছিলেন। কিন্তু সকালে পত্রিকা মারফত তিনি জানতে পারলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী আজ ঢাকায় আসছেন না। ঢাকায় আসার তারিখ তিনি দুদিন আগেই পিছিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতিকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহর মেয়াদও শেষ হয়।

শেখ মুজিবুর রহমান : ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় রাষ্ট্রপতি হন। শেখ মুজিবুর রহমানের যে পদক্ষেপ নিয়ে এখনো সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়, সেটি হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এই শাসন ব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত।

এই শাসন ব্যবস্থা শেখ মুজিবুর রহমান খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। বাকশাল প্রবর্তনের মাত্র সাত মাসের মাথায় সেনাবাহিনীর তৎকালীন কিছু কর্মকর্তা তাকে হত্যা করে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমদ।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। তিনি মোট ৮১ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের গঠিত বাকশালে খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানের পর ৫ নভেম্বর তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম :  খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি। তিনি রাষ্ট্রপতি হলেও তখন রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল কার্যত সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হাতে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন ‘ক্ষমতাহীন’ রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সংসদ ও মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দিয়ে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। এ বিষয়টিকে অনেকে নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করেন। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বেসামরিক রাষ্ট্রপতি কীভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হতে পারেন সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল।

নির্বাচন অনুষ্ঠানে অপারগতার জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহামানের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের পর অবসর জীবনে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম একটি বই লিখেছেন ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেইজ’। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যান।’ মূলত; তাৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান চাননি যে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম আর রাষ্ট্রপতি থাকুক।

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। যদিও তার পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যর বিষয়টি।

জিয়াউর রহমান : ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সরিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন।

ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। এ নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বলে অভিহিত করেন।

জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ না ছেড়েই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি গঠন করেন।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে একদল সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে।

আব্দুস সাত্তার: জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সহ-সভাপতি পদে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৬% ভোট পেয়ে তিনি নির্বাচিত হন। যদিও সে নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে সেনাপ্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন।

আহসান উদ্দিন চৌধুরী: ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। এর তিনদিন পর, অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ৩০ মার্চ জেনারেল এরশাদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান।

কিন্তু বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীর কোনো প্রকার কর্তৃত্ব ছিল না, কারণ ঘোষিত সামরিক আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ছিল যে সিএমএলএ’র উপদেশ বা অনুমোদন ব্যতীত প্রেসিডেন্ট কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ বা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না।

আহসান উদ্দিন চৌধুরী ২০ মাসের মতো রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এক পর্যায়ে জেনারেল এরশাদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি হন।

এইচ এম এরশাদ: রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 0জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময় দুটো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটি ১৯৮৬ সালে এবং আরেকটি ১৯৮৮ সালে। এ দুটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল।

জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ধীরে ধীরে সোচ্চার হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সবগুলো বড় রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন জেনারেল এরশাদ।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ : নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারী তিন জোটের অনুরোধে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তার প্রধান দায়িত্ব ছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একই সাথে প্রধান নির্বাহী এবং রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

১৯৯১ সালের সে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরল সমঝোতায় দ্বাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর উত্তরসূরি নির্বাচন করেই তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে গিয়েছিলেন।

নতুন রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণের পর সাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে ফিরে যান। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আব্দুর রহমান বিশ্বাস: ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আব্দুর রহমান বিশ্বাস। আব্দুর রহমান বিশ্বাস বরিশালে আইন পেশা এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বরিশাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর আব্দুর রহমান বিশ্বাস আব্দুস সাত্তার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে আব্দুর রহমান বিশ্বাস ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মূলত রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

এরপর ৪ এপ্রিল ১৯৯১ তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৬ সালের ৮ অক্টোবর তাঁর মেয়াদ শেষ হয়।

সাহাবুদ্দিন আহমদ: ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাহাবুদ্দিন আহমদকে আবারো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে সংসদের মাধ্যমে। সে বছরের ৯ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামের একটি বিতর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।

সেকারণে তাঁর সাথে তৎকালীন সরকার এবং আওয়ামী লীগের তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। তখন থেকে সেই সম্পর্কে আর উন্নতি হয়নি। ২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজিত হবার পর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ এনেছিলেন।

সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি অতি সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে সাহাবুদ্দিন আহমেদ তার নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য প্রশংসিত ছিলেন।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী: ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ১৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু সাত মাসের মাথায় ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে  পদত্যাগ করেন। সেসময় বিএনপি সংসদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিল।

বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হবার পর এমন নাটকীয় পদত্যাগের ঘটনা আর ঘটতে দেখা যায়নি। তার আগে বিএনপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অনেক সংসদ সদস্য দাবী তোলেন যে রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করুন। অন্যথায় তাকে ইমপিচ করার হুমকি দেন তাঁরা।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার মাত্র সাত মাস সাত মাসের মাথায় বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে কেন বিদায় নিতে হয়েছিল, তার নানাবিধ কারণ উল্লেখ করে তখনকার সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল।

যেসব কারণের কথা ওইসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে: জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা। রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা। বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ। রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা, কারণ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বিষয়টি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে।

এছাড়া বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন। এটি নিয়ে বিএনপি বেশ নাখোশ ছিল।

ইয়াজউদ্দিন আহমদ: বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতির পদের জন্য বিএনপির তরফ থেকে পছন্দ করা হয় অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদকে। ২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্বও নেন, যা সেই সময় দেশের রাজনীতিতে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল বলে মনে করা হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেব দায়িত্ব নেন ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানেরও দায়িত্ব নেওয়াটা তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয় এবং তার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পদ্ধতিটি কিছুটা নিয়মের লঙ্ঘন বলেও মনে করেন অনেকে।

ইয়াজউদ্দিন আহমদ বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি হলেও তাকে নিয়ে এক পর্যায়ে বিএনপি নেতারাও সমালোচনা করেছিলেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ২০০৭ সালে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ থামাতে তিনি কোনো ভূমিকা রাখেননি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইয়াজউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন।

জিল্লুর রহমান:  ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয়া জিল্লুর রহমানকে। ২০০৮ সালে জিল্লুর রহমান জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নবম জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। জিল্লুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন ছিল সুদীর্ঘ।

২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর।

আব্দুল হামিদ:  জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদ। তিনি হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি পরপর দুই মেয়াদে দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি প্রথম মেয়াদে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল এবং দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়