বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন: ঠাৎ করে গুজব নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। কারণ ‘খবর’ বেরিয়েছে, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল মধ্যরাতে তার পদ ছেড়েছেন।
শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী নাকি তার বাসভবন ‘যমুনা’ ঘেরাও করে রেখেছিলো। সেনাবাহিনী এবং বিক্ষুব্ধ সেনা সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন।
বিভিন্ন সুপরিচিত মিডিয়া হাউজের আদলে ফটোকার্ড বানিয়ে এই ‘খবর’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল রাতভর মানুষ সেসব কার্ড ফেসবুকে পোস্ট ও শেয়ার করেছেন।
এই গুজবের ২৪ ঘণ্টা হতে চললো, কিন্তু এখনও এ নিয়ে পোস্ট দেওয়া বন্ধ হয়নি।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও এ নিয়ে একটি পোস্ট করেছেন। বুধবার সকালে তিনি তার অফিশিয়াল ফেসবুক প্রোফাইল থেকে লিখেছেন, “শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স: চালাইদেন।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের গুজবের সূত্র হিসাবে ‘চালাইদেন’ শব্দটি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিলো। তখন আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই নিজেরা মজা করে এই শব্দটা নিজেদের ফেসবুক পোস্টে ব্যবহার করেছিলেন।
আপাতদৃষ্টিতে এসব তথ্য নিয়ে অনেকে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করলেও গণমাধ্যমের জন্য এটি বিব্রতকর। কারণ, ধারাবাহিকভাবে তাদের নাম, লোগো ব্যবহার করে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত গুজব: প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের বিষয়ে এখন যে গুজবটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলমান, তার সূত্রপাত মুফাসসিল ইসলাম নামক একজনের একটি ফেসবুক পোস্ট।
তিনি তার পোস্টে দাবি করেছেন যে প্রধান উপদেষ্টা সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে পরিবর্তন করার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান তা জেনে যান।
“এটা নিয়ে সেনাপ্রধান ও ইউনূসের মাঝে ভালোমন্দ অনেক কথাবার্তা হয়েছে…রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ড. ইউনূসকে ঘিরে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রূদ্ধশ্বাস বৈঠক চলছে। বিক্ষুব্ধ আর্মি অফিসাররা ইউনূসকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।”
কিন্তু বাংলাদেশের একটি তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার এমন দাবির কোনও সত্যতা খুঁজে পায়নি বলে নিশ্চিত করে বলছে বিষয়টি ‘গুজব’।
এদিকে, সম্প্রতি আরেকটি ‘গুজব’ ছড়িয়েছে যে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে নয়, এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অবস্থান করছেন।
কিন্তু এ জাতীয় সব খবরকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ বলেছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা।
গতকাল দিল্লি থেকে বিবিসি বাংলা’র সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন– এবং তারা প্রত্যেকে নিশ্চিত করেছেন ‘শেখ হাসিনা এখানে গত সপ্তাহে যেভাবে ছিলেন, এই সপ্তাহেও ঠিক একইভাবেই আছেন!’
এছাড়া, দূর্গাপূজাকে সামনে রেখে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙা বিষয়ক গুজব প্রতিনিয়ত সামনে আসছে।
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে গত দুই মাসে এই ঘটনা আরও বেশি বেশি ঘটছে। গত পাঁচই অগাস্ট থেকে শুরু করে এখন অবধি টুইটার ও ফেসবুকে প্রায় ৭৬টি সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা শনাক্ত করেছে ফেক্টচ্যাক বিষয়ক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার।
এদিকে, ওইসব গুজবের অধিকাংশেরই উৎপত্তি ভারতে, এমনটাই জানিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হেড অব অপারেশন সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী। তিনি আরও বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও রিউমার স্ক্যানার ১৮টি গুজব শনাক্ত করেছে।
২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসে প্রতি মাসে গড়ে ২০০টি গুজব এবং সরকার পরিবর্তনের পরবর্তী দুই মাসে (অগাস্ট ও সেপ্টেম্বরে) প্রতিমাসে গড়ে ৩৩০টি গুজব শনাক্ত করেছি আমরা, বলেন মি. চৌধুরী।
এমন পরিস্থিতিতে একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে যে কোনটা সঠিক তথ্য, আর কোনটা ভুল?
আপনার যা করণীয় : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের বরাতে ফ্যাক্টচেকার সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইন্টারনেটে কোনও তথ্য সম্পর্কে সন্দেহ করা কিংবা তথ্যটি শেয়ার করার আগে যাচাই-বাছাই করার জন্য কিছু স্পষ্ট সংকেত রয়েছে, যেগুলোকে 'রেড ফ্ল্যাগ' বলা হয়।
তিনি জানান, ইন্টারনেটে কোনও তথ্য দেখে যদি বিস্ময় বা বিতৃষ্ণা জাগে, তাহলে তথ্যটি শেয়ার করার আগে যাচাই করতে হবে। কিংবা, ইন্টারনেটে পাওয়া কোনও তথ্যকে যদি আপনার মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও মনে হয়, সেক্ষেত্রেও তা শেয়ার করার আগে যাচাই করতে হবে।
বিশেষ করে, কোনও তারিখ বা লেখকের নামহীন তথ্য বা নিবন্ধ মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
যদি কোনও তথ্য এমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া হয়, যে অ্যাকাউন্টের ব্যবহারকারীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না এ সকল অ্যাকাউন্ট কিংবা তথ্য ফেইক হতে পারে। এমনকি কারও প্রোফাইল ভেরিফায়েড থাকার অর্থ এই নয় যে তারা যা পোস্ট করছে সে বিষয়টিই সত্য।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভুল তথ্য ছড়ানোর জন্য একজন সাধারণ ব্যবহারকারী অনলাইনে রাজনীতিবিদ বা সেলিব্রিটির ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে, বলছিলেন তিনি।
“এখন অনেক মিডিয়া হাউজের নামে ফটোকার্ড ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার করে খবরটি শেয়ার করা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হ্যান্ডেলগুলোতে চোখ রাখলেও সত্য-মিথ্যা বোঝা যায়,” তিনি যোগ করেন।
অনেকসময় কোনও ব্যক্তির বরাতে ফটোকার্ড বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও ‘খবর’ প্রচার করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে যার বরাতে খবরটি দেওয়া হচ্ছে, তার ফেসবুক পেজও যাচাই করা যেতে পারে। কিংবা, সম্ভব হলে সরাসরি ওই ব্যক্তির সাথেও যোগাযোগ করা যায়।
“তবে ফটোকার্ড বানালেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওরা ফন্ট নকল করতে পারে না। আবার, যে ছবিটা ব্যবহার করছে, সেগুলোর ফ্রেম হুবহু ওই গণমাধ্যমের হচ্ছে না। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।”
এমনকি গণমাধ্যমে প্রচারিত সকল তথ্যকে চট করে বিশ্বাস করতেও নিরুৎসাহিত করেন মি. চৌধুরী।
ইমেজ সার্চ দিয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়
ছবির ক্যাপশান,ইমেজ সার্চ দিয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়
গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যে একমাত্র সূত্র হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উল্লেখ করা হলে কিংবা একটি তথ্য নিয়ে বেশিরভাগ গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত না হলে তা বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে বলেন ফ্যাক্টচেকাররা।
“যখন একটি নির্দিষ্ট ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রচার করে, দুর্ঘটনাজনিত সংবাদে সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এমন ছবি বা ভিডিও প্রচার হলে, দেশের সংবাদ মাধ্যমে ভিনদেশের কোনও ঘটনা নিয়ে প্রচারিত প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে সংশ্লিষ্ট ভিনদেশের মূলধারার গণমাধ্যম বাদে অনলাইন নিউজ পোর্টালের কথা উল্লেখ থাকলে সেই
তথ্য যাচাইয়ের পদ্ধতি : কোনও তথ্য নিয়ে সন্দেহ হলে কেউ চাইলে রিউমর স্ক্যানার বা ডিসমিসল্যাবের মতো ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, গ্রুপ পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
কেউ চাইলে ঘরে বসে নিজে নিজেও প্রযুক্তির সহায়তায় তথ্য যাচাই করতে পারেন।
মি. চৌধুরী জানিয়েছেন, ছবি যাচাই করার সবচেয়ে সহজ উপায় হছে ইমেজ সার্চ। বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে ইমেজ সার্চের অপশন দেখা যায়। গুগলের ক্ষেত্রে এর নাম গুগল ইমেজ সার্চ।
ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে পাঠককে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনও ওয়েবসাইট নিয়ে যদি সন্দেহ হয়, তাহলে আইসিএএনএন ওয়েবসাইট থেকে তার সত্যতা সহজেই যাচাই করা যাবে।
অনেকসময় স্থান নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়। সেক্ষেত্রে গুগল স্ট্রিট ভিউ অপশন ব্যবহার করা যায়।
গুজব বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? : শুধু বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানই নয়, তথ্য প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবিরও বিবিসি বাংলাকে জানাচ্ছেন যে গত দু’মাসে বাংলাদেশে গুজবের পরিমাণ বেড়েছে।
গুজব বৃদ্ধির একটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। তার মতে, দীর্ঘসময় বাংলাদেশের মানুষ বাকস্বাধীনতা পায়নি এবং গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।
“তখন সাধারণ মানুষ নিয়মিত গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে।”
সে কারণেই মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা দেখছে, সেটিকেই বিশ্বাস করতে চাইছে। পাঁচই অগাস্টের আগেও পক্ষে-বিপক্ষে নানান ধরনের গুজব ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, যে গোষ্ঠী আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল, তারা হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা দেশে অস্থিরতা চাচ্ছে, তারা গুজব ছড়াচ্ছে।”
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিনি মিডিয়া ও সরকারকে সচেতনতা তৈরি করতে আহ্বান জানান।
সাম্প্রতিক সময়ে যেসব গণমাধ্যমের নামে সবচেয়ে বেশি ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম যমুনা টেলিভিশন।
প্রতিষ্ঠানটি প্রধান বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, “এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে চোর চুরি করে তা কোথাও না কোথাও বিক্রি করছে। কিন্তু ক্রেতারা ধরতে পারছে না যে এটা নকল জিনিস।”
সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নামে ফটোকার্ড বানিয়ে মিথ্যা খবর প্রচারের প্রবণতা “কল্পনাতীত হারে বেড়েছে” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা কিছু কিছু ঘটনায় থানায় অফিশিয়ালি অভিযোগ করেছি।”
কারণ ওইসব তথ্য তাদের জন্য একদিকে যেমন মানহানিকর, অপরদিকে সেগুলো প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছিলো। সেইসাথে, পাঠক বা দর্শকরাও ঝুঁকির মাঝে পড়ছে।
“এই প্রবণতা বাড়ার একটি কারণ এমন হতে পারে যে আন্দোলনের সময় যমুনা টেলিভিশনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিলো। ওই সুবিধাকে কাজে লাগানোর জন্য বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এই কাজগুলো করছে।” সূত্র; বিবিসি বাংলা
আপনার মতামত লিখুন :