বিশ্বজিৎ দত্ত: [২] বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে শেখ হাসিনার চীন সফর। এই সফরের আগেই ভারতের সংবাদ মাধ্যমে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী হয়তো এবার চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কোন চুক্তি করে ফেলতে পারেন।
[৩] কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে কোন আলোচনাই করেননি। এমনকি চীনের পক্ষ থেকে দেয়া বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগের( জিএসআই) বিষয়েও নীরব থেকেছে বাংলাদেশ। যা ভারতকে এই মূহুর্তে অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে।
[৪] অন্যদিকে তাইওয়ান চীনের অংশ যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছে চীন। এই স্বীকৃতি চীনকেও সন্তুষ্ট করেছে। এবারই প্রথম বাংলাদেশের কাছ থেকে তাইওয়ান প্রশ্নে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য পেয়েছে চীন।
[৫] প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে চীনের অর্থনৈতিক সাপোর্ট প্রত্যাশা করেছিল ঢাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সাইড লাইনে চীনা প্রতিনিধি বাণিজ্য সহায়তা হিসাবে বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ চীনা মুদ্রা প্রদানের প্রস্তাব করেছিল।
[৬] যা নিয়ে গত চার মাস ধরে নেগোসিয়েশনে কাটায় দুই দেশ। পররাষ্ট্র সচিবের বেইজিং সফরে এবং ইআরডি’র সঙ্গে সিরিজ বৈঠকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছিল।
[৭] এই সফরে ৫০০ কোটি ডলার ঋণের এই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ ঘোষণায় ঋণ প্রাপ্তির বিষয়ে চীনের একটি টেকনিক্যাল কমিটি বাংলাদেশ সফর করবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়টি শুধু ৫ বিলিয়নই নয়, ভবিষ্যতে আলোচনায় আরো বিস্তৃতির একটা বিষয় যুক্ত হয়েছে। কারণ টেকনিক্যাল কমিটি আলোচনায় সন্তুষ্ট হলে এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধিও করতে পারবে ।
[৮] তবে অনুদান হিসাবে খুব দ্রুতই ১০০ কোটি ইউয়ান (১৬০০ কোটি টাকা) পাবে বাংলাদেশ।
[৯] প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের অর্জন বিশ্লেষণ করেছে চীনের মিডিয়া গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে । সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি করতে চায় তাহলে অবশ্যই চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন।
[১০] ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেতে ঘনিষ্ঠ হওয়া দেশগুলোর ওপর অপরিহার্যভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা চাপ বাড়াচ্ছে। চীন এক্ষেত্রে তৃতীয় কোন দেশকে এই সম্পর্কে টার্গেট করবে না।
[১১] গত বুধবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, তৃতীয় কোনো পক্ষকে টার্গেট করবে না চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন। লি কিয়াং বলেন, চীন সবসময়ই ‘জিরো-সাম’ গেমের বিরোধী এবং চীনের অবস্থান হলো পারস্পরিক সুবিধা ও সহযোগিতার পক্ষে। তিনি আরও বলেন, জটিল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৌশলগত পছন্দকে সম্মান করে চীন। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কে বেইজিংয়ের যে আপত্তি নেই তা-ও খোলাসা করেন তিনি।
[১২] প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে সমাপনীতে ২৭ দফা যৌথ ঘোষণা প্রকাশ পেয়েছে। ভবিষ্যতের দলিল হিসেবে থাকা ওই জয়েন স্টেটমেন্টে যেসব বিষয়ে দু’পক্ষ এক হয়েছে বা ছাড় দিয়ে রাজি হয়েছে তা-ই স্থান পেয়েছে।
[১৩] প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সব পর্যায়ে এবং বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী ও বিভাগের মধ্যে বিনিময় আরও জোরদার করতে এবং ব্যবহারিক সহযোগিতাও বাড়াতে রাজি হয়েছে চীন-বাংলাদেশ।
[১৪] জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণের বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পৃক্ততা ধরে রাখতে একমত হয়েছে দুই দেশ।
[১৫] বাংলাদেশ থেকে চীনে আম রপ্তানির প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে পাট, চামড়া, জলজ পণ্য এবং অন্যান্য উচ্চমানের বিশেষ পণ্য রপ্তানি সমপ্রসারণে বাংলাদেশকে চীন স্বাগত জানায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চমানের বাংলাদেশি কৃষিপণ্য চীনে রপ্তানির বিষয়ে যোগাযোগ আরও নিবিড় করতেও উভয়ে সম্মত বলে জানানো হয়।
[১৬] প্রধানমন্ত্রী সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরেকটি বড় চাওয়া ছিল সাউদার্ন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (সিডি) বা পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে চীনের সম্পৃক্ততা। এ বিষয়ে বেইজিং ইতিবাচক।
[১৭] সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক এবং ২১টি সমঝোতা স্মারক, সাতটি ঘোষণা এবং ১৬টি ব্যবসায়িক সমঝোতার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
[১৮] বিবৃতিতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে আরও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে আশা করা হয়েছে, একসঙ্গে পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে উভয়পক্ষই লাভবান হবে।
[১৯] যৌথ বিবৃতিতে সাবওয়ে, মেট্রোরেল ও সড়ক; তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান; হাসপাতাল এবং পানিসম্পদ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের বিষয়ে চীনের এন্টারপ্রাইজগুলোকে উৎসাহিত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
[২০] যৌথ বিবৃতির সূচনাতে রোহিঙ্গাদেরকে ‘মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্রুত প্রত্যাবাসনই সেই সংকটের সমাধান তাও উল্লেখ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি।
[২১] দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্বিঘ্নভাবে অনুষ্ঠানের জন্য ও বিজয়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানিয়েছে চীন।
[২১] ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ও চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ তম বার্ষিকি একসঙ্গে উদযাপন করবে বলেও ঘোষণা এসেছে।
[২২] চীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জনকে সাধুবাদ জানানো ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। সম্পাদনা: এম খান
এসবি২
আপনার মতামত লিখুন :