মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন: কোটা একটা ইকুয়েটি টুল। আরেক অর্থে প্রটেকশিনিজম। বৈষম্যের হিস্ট্রিকাল লিগেসি বহন করা পোস্ট কলোনিয়াল কান্ট্রিগুলোতে বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণিকেন্দ্রিক নয়। এটা বহু মাত্রিক। এখানে এথনিক বৈষম্য আছে, লৈংগিক বৈষম্য আছে, রিলিজিয়াস বৈষম্য আছে, এমনকি জেলা ও অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য ও আছে। তাই কোটার প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি অস্বীকার করার মতো অবস্থা আমাদের এখনো আসেনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা তো এথনিক, রেসিয়াল, লৈঙ্গিক গ্রুপ না। তাহলে কোন বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা? এটা এক লেন্সে একধরনের একনলেজমেন্ট কোটা। পৃথিবীর প্রায় সব কালচারেই ওয়ার হিরোদের প্রশংসা করা হয়, নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এটা আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত সত্য। কিন্তু বিশেষ সুযোগ সুবিধা, ভাতা, যানবাহনে প্রায়োরিটি, নানা ডিসকাউন্ট সহ ফ্রি এডমিশন,প্রায়োরিটি বোর্ডিং সব ওয়ার হিরোর জন্য বরাদ্ধ। তার সাথে ভ্রমণ করলে তার ফ্যামিলিও সেই সুযোগ পায়। এর বাইরে বিশেষ বিবেচনায় যুদ্ধাহতরা চাকরিও পায়। এইগুলো নিয়ে খুব একটা বিতর্কের কিছু দেখি না আমি।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়Ñ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজন, সন্তান, নাতি-নাতনিরা রাষ্ট্রীয় চাকরিতে বিশেষ কোটা সুবিধা পেতে পারে কিনা? ইকুয়েটি অর্থে পারে না। কারণ সরাসরি তাদের রাষ্ট্রীয় অবদান নেই। রাষ্ট্রীয় অবদান ইম্মোবেল প্রপার্টির মতো ইনহেরিটেন্স অনুযায়ী ট্রান্সফার হওয়ার নজির আধুনিক সমাজে পাওয়া যায় না খুব একটা। ধরেন, আপনি একটা পদক পেলেন, সেই পদক আপনার মৃত্যুর পর কি আপনার সন্তানের নামে হবে? নাতি-নাতনীর নামে হবে? পদকের সাথে অর্থ প্রাপ্তি, এমনকি প্লট দিলে সেটা ইনহেরিটেন্স ট্রান্সফার হতে পারে। কিন্তু চাকরির মতো পাবলিক সার্ভিসে এমন কোনো প্রিভিলেজ কোটা থাকার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।
এখানে একটা গুরুতর অভিযোগ কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতা পরবর্তী কিছু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্ত সম্মান ও অধিকার বঞ্চিত করেছে। সেই অর্থে অনেকে অভিযোগ করে তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেইটা কারেকশন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে তাদের ভাতা, ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কিন্তু স্বজনদের চাকরিতে কোটা কোনোমতেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের স্বীকৃতি না, বরং রাষ্ট্র পলিটিকাল টুল হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জনকে ব্যবহারের প্রয়াস। এখানে আরেকটা নৈতিক প্রশ্ন আসেÑ মুক্তিযোদ্ধারা কি চাকরি ব্যবসায় তাদের সন্তানদের এক চেটিয়া প্রবেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলো নাকি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলো? আমার ধারণা যেকোনো সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলে দ্বিতীয় অংশই উত্তর হবে। তাহলে স্বজনদের কোটা যে সমাজে নতুন বৈষম্য তৈরি করবে সেই বৈষম্যের দায় মুক্তিযোদ্ধাদের উপর চাপিয়ে কেউ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন আসবেই।
তারপরেও আমি নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়া এই সমাজে কোটা পুরো তুলে দেওয়ার পক্ষে সাফাই গাইছি না। তবে কোটা পুনঃবিন্যাস হতে পারে। যে কৃষক অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে তার সন্তানদের জন্য কোটা থাকতে পারে, গার্মেন্টেস কর্মীর সন্তানদের জন্য কোটা থাকতে পারে, আদিবাসীর জন্য কোটা থাকতে পারে, চরাঞ্চলের জন্য কোটা থাকতে পারেÑ মোটা দাগে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। সেসব কোটার মধ্যে কেউ যদি সরাসরি যুদ্ধের অংশগ্রহণ করে থাকে এমন পরিবারের সন্তানকে তখন অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে নিয়োগের কোনো একটা প্রক্রিয়ায়। এই যেমন- একজন কৃষক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৫ মার্ক বোনাস পেতে পারে লিখিত পরীক্ষায়। কিন্তু বাকি ধাপগুলো তাকে কমপ্লিট করতেই হবে।
এখন যেভাবে গ্রস মুক্তিযোদ্ধা কোটা, সেটার সুযোগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা- যাদের প্রয়োজন তারা পাচ্ছে কিনা সেই ন্যায্য প্রশ্ন তোলা উচিত। একজন সচিব যখন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়ায় এটা অনাচার, একজন সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধা পায় এটা সাম্য না, বরং অপব্যবহার। তাই এটাকে স্পেসেফিক করা উচিত। একটা টাইম লাইন ঠিক করা উচিত- কত বছর এই কোটা ব্যবস্থা থাকবে? অনির্দিষ্ট কাল কোনো কোটা চলতে পারে না। কোটা মানেই একটা টার্গেট। সরকার সেই টার্গেট ও টাইম লাইন ক্লিয়ারলি বলুক। আর তৃতীয় প্রজন্ম তো কোটার সুবিধা পাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। রাষ্ট্র কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না যে বংশ পরম্পরায় একটা শ্রেণি বিশেষ সুবিধা পাবে। সেই যেই হোক। সাময়িক প্রয়োজনে সেটা চলতে পারে, তবে অবশ্যই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার উদ্দেশ্য হলে। নতুন বৈষম্য চাপিয়ে দিয়ে না। লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র
আপনার মতামত লিখুন :