গত তিন বছরে কেয়ার ভিসা ও তাদের ডিপেন্ডেন্ট হিসেবে ব্রিটেনে এসেছেন বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি। যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই স্বপ্নের দেশে এসে বাস্তবতার কারণে স্বপ্নভঙ্গের দহন নিয়ে গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। স্পন্সর লাইসেন্স ও কস বিক্রির জন্য পূর্ব লন্ডনে রীতিমতো প্রকাশ্যে কোম্পানি খুলে ওয়ার্ক পারমিট কেনাবেচা ও দালালির ব্যবসা করেছেন আইনজীবী নামধারী কিছু লোক। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশিরাও।
লন্ডনের চ্যান্সেরি সলিসিটর্সের প্রিন্সিপাল সলিসিটর ব্যারিস্টার মো. ইকবাল হোসেন বুধবার (১৯ মার্চ) বলেন, কেয়ার ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের কস ব্যবসা করে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে হঠাৎ বিলিয়নিয়ার হয়ে যাওয়া একটি নতুন শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। তারা দালালি-প্রতারণা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। অনেকে দুবাইসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু কেয়ার ভিসায় আসা বহু মানুষ এখনও পরিবার নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এর পেছনে সরকারের বারবার সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা পরিবর্তনও বড় কারণ।
তিনি যোগ করেন, যে কেয়ার হোম মালিকের ৫ জন কর্মীর দরকার তিনি ৪০ জন এনেছেন। নিযোগদাতার প্রতিশ্রুত কর্ম ঘণ্টা ও বেতনের অর্ধেকও পাচ্ছেন না আমাদের হাজারো কর্মী। আবার এমন কর্মীও এসেছেন যারা কেয়ার দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত না, ন্যূনতম ধারণা নেই। তারা যাদের কেয়ার দেবেন সেসব ব্রিটিশদের কথাও বুঝতে পারেন না। হোম অফিসের উচিত ছিল প্রথম থেকেই যিনি কেয়ার ভিসায় আসছেন কর্মী হিসেবে তার দক্ষতা যাচাই বা নিশ্চিত করা।
যুক্তরাজ্যের অভিবাসন ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কারণ কাজের ভিসার নিয়মকানুন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এমনকি সরকারি পর্যবেক্ষকদের তীব্র সমালোচনা চলছে। বিতর্কটি দক্ষ কর্মী ভিসা রুটে সাম্প্রতিক এবং আসন্ন পরিবর্তনের কার্যকারিতা এবং প্রভাবের বিষয় নিয়ে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব এবং অভিবাসী কর্মীদের প্রতি আচরণ নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ন্যাশনাল অডিট অফিস জানিয়ে, ২০২২ সালে ৫৩টি থেকে ২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে স্কিলড ওয়ার্কার ভিসাধারীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০ জনে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ তথ্য এমন এক সময় সামনে এলো যখন সরকার গ্রীষ্মে প্রত্যাশিত একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যা যুক্তরাজ্যের ভেঙে পড়া অভিবাসন সিস্টেম ‘পুনরুদ্ধার’ করার পরিকল্পনা তৈরি করবে।
জাতীয় নিরীক্ষা অফিসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। যা ভিসা নীতির প্রভাব পরিচালনা এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র দফতরের পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য ত্রুটিগুলো প্রকাশ করেছে।
এনএও উল্লেখ করেছে যে দক্ষ কর্মী ভিসা রুটে অনেক পরিবর্তন তাদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা বা পরিকল্পিত যাচাই ছাড়াই বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে দক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসাগুলোর জন্যও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২২ সাল থেকে প্রণীত পরিবর্তনের প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।
ভিসাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল পর্যবেক্ষণ করার জন্য স্বরাষ্ট্র দফতরের ক্ষমতা এবং যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ভিসা রুটের সামগ্রিক অবদান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে। দক্ষ কর্মী ভিসা রুটের মধ্যে অসম্মতি এবং কর্মীদের শোষণের বিষয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কথাও তুলে ধরা হয়েছে।
অ্যাসাইলামের আশ্রয় দাবি বৃদ্ধি প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দক্ষ কর্মী ভিসাধারীদের আশ্রয় দাবির সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রবণতা এবং দেখায় যে সিস্টেমটি আশানুরূপভাবে কাজ করছে না।
স্পন্সর লাইসেন্স বাতিলকরণ: অপব্যবহার এবং শোষণের কারণে, হোম অফিস অসংখ্য স্পন্সর লাইসেন্স বাতিল করেছে, বিশেষ করে কেয়ার সেক্টরে।
ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে কঠোর ভিসা নিয়ম বিদ্যমান শ্রমিক ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি এবং আতিথেয়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে। এদিকে, অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো দুর্বল অভিবাসীকর্মীদের শোষণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
‘সঠিক মূল্যায়ন ছাড়াই করা এই পরিবর্তনগুলো অপরিহার্য শিল্পগুলোকে পঙ্গু করে দেওয়ার এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলকতাকে ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি তৈরি করছে,’ বলে মন্তব্য করেন শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়িক অ্যাডভোকেসি গ্রুপের একজন প্রতিনিধি।
অভিবাসী অধিকার সংস্থাগুলোও এই পরিবর্তনের নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তি দিয়েছে যে এটি বিদেশি কর্মীদের জন্য একটি প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করবে।
‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে এই নীতিগুলো শোষণ বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে এবং অনেক দুর্বল ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়াই রাখবে,’ এমনটাই বলেছেন একটি বিশিষ্ট অভিবাসী সহায়তা দাতব্য সংস্থার একজন মুখপাত্র।
সরকারের অবস্থান: স্বরাষ্ট্র দফতর তাদের দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করে বলেছে যে অভিবাসন ব্যবস্থা যাতে যুক্তরাজ্যের সর্বোত্তম স্বার্থে কাজ করে তা নিশ্চিত করার জন্য এই পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন। তারা জানিয়েছে, তারা এই ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা আরও জানান, ভাঙা অভিবাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে। তবে, ‘এনএও’ রিপোর্টের ফলাফল সরকারের দাবির ওপর সন্দেহ প্রকাশ করেছে। এর অভিবাসন নীতির কার্যকারিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সামনের কী ঘটতে পারে: নতুন অভিবাসন নিয়মাবলি যত সামনে আসছে, বিতর্ক তত তীব্র হতে চলেছে। ব্যবসায়ী, অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এবং ওয়াচডগদের উত্থাপিত উদ্বেগগুলো সমাধানের জন্য সরকার ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি এবং সমাজের ওপর এই পরিবর্তনগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ধারণের জন্য আগামী মাসগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। উৎস: বাংলা ট্রিবিউন