শিরোনাম
◈ সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার এখনও পাননি  স্মার্টকার্ড  ◈ আজ জাতীয় শহীদ সেনা দিবস: বিডিআর হত্যাযজ্ঞের ১৬ বছর ◈ বেলজিয়ামে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, বিধ্বস্ত চেহারায় প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ ◈ সংস্কার হতে হবে নির্বাচনমুখী: আন্দালিব রহমান পার্থ ◈ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিলেন তৌহিদ হোসেন ◈ একদিন ম্যানেজ হলে ঈদে মিলবে টানা ৯ দিনের ছুটি ◈ বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা: কারাগার থেকে পালিয়েছেন ফাঁসির আসামি জেমি ◈ সাজেক ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করে প্রশাসনের বার্তা ◈ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াত আমিরের বৈঠক, অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত ◈ শুক্রবার আত্মপ্রকাশ করছে ছাত্রদের নতুন দল

প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:৫০ রাত
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৪:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বেলজিয়ামে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, বিধ্বস্ত চেহারায় প্রকাশ্যে হাছান মাহমুদ

একুশে ফেব্রুয়ারি বেলজিয়াম দূতাবাসের ভেতর থেকে ছোট ভাই মোরশেদ মাহমুদ যখন পালাচ্ছিলেন, হাছান মাহমুদ তখন ব্রাসেলসেই কয়েক মিনিটের জন্য দেখা দিলেন বিধ্বস্ত চেহারায়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিন প্রতিবেদন: ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে পলাতক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ভাইসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। দূতাবাসের ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স প্রীতি রহমানকে দায়ী করছেন। গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর হাছান মাহমুদ পালিয়ে বেলজিয়াম চলে যান। সেখানে তিনি অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সাতজনের একটি অনুষ্ঠানে প্রথম প্রকাশ্যে এলেন কয়েক মিনিটের জন্য।

জানা গেছে, শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিলনায়তনে মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় হাছান মাহমুদের ছোট ভাই মোরশেদ মাহমুদ, বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহীদ, সাবেক সভাপতি বজলুর রশিদ বুলু এবং বেলজিয়াম যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মিনহাজসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে। এ সময় অনুষ্ঠানে কয়েকজন বিএনপি নেতাও উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক প্রবাসী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতারা মিলে অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধ ভালোভাবেই শেষ করেন। কিন্তু বেলজিয়াম যুবদলের কয়েকজন নেতা দূতাবাসে আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে অনুষ্ঠানস্থলে ছুটে যান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ প্রবাসীরাও।

ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা এ সময় অডিটরিয়ামে ঢুকে ‘ভুয়া ভুয়া’ ‘হাসিনার দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’সহ বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিতে থাকেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সামনে গিয়ে তারা বলেন, ‘বাংলাদেশে এতো বড় ঘটনা ঘটিয়ে আপনার কিভাবে এখানে আসার সাহস করেন? আপনাদের লজ্জা করে না?’

হাছান মাহমুদের ভাই মোরশেদ মাহমুদকে লক্ষ্য করে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা এ সময় বলেন, ‘এই লোক দশের শত্রু দেশের শত্রু। এই লোক কিভাবে অ্যাম্বেসিতে আসে?’

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকায় বেলজিয়ামে হাছান মাহমুদের সব অবৈধ সম্পদ দেখভাল করেন তার ছোট ভাই মোরশেদ মাহমুদ। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবেই থাকেন। দূতাবাস কব্জা করার জন্য পরে মোরশেদকে দূতাবাসের রিসিপশনিস্ট হিসেবে চাকরিও দেওয়া হয়। মাসে মাসে বেতন তুললেও দূতাবাসে তিনি কোনো কাজ করতেন না। পদে রিসিপশনিস্ট হলেও ভাইয়ের জোরে তার ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্রদূতের চেয়েও বেশি।

বিএনপির কয়েকজন নেতা এ সময় দূতাবাস কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হাছান মাহমুদের ভাই দূতাবাসের অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায়। আমাদেরকে দাওয়াত দিছেন? আমরা তো ব্রাসেলসে ছিলাম।’ এ সময় কর্মকর্তারা নিরুত্তর থাকেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই প্রবাসী জানান, অনুষ্ঠানস্থলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগের আমন্ত্রিত নেতাদের দূতাবাস থেকে বের করে দেওয়া হয়।

দূতাবাসে আগের ভূত!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রবাসী বেলজিয়াম থেকে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা আগের মতোই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ভাব রেখে চলছে। এদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি।’

বেলজিয়ামের বাংলাদেশ দূতাবাসে বর্তমানে কোনো রাষ্ট্রদূত নেই। গত বছরের অক্টোবরে বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান সালেহকে দায়িত্ব ছেড়ে ‘অনতিবিলম্বে’ ঢাকায় ফেরার নির্দেশনা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই থেকে তার বর্তমান অবস্থান এখন পর্যন্ত অজানা। দুই মাস পর ডিসেম্বরে তার অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে দূতাবাসটির চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে আছেন প্রীতি রহমান।

বেলজিয়াম বিএনপি, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন, ‘দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স প্রীতি রহমান আওয়ামী লীগের দোসরদের এই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছেন।’

বিধ্বস্ত চেহারায় হাছান মাহমুদ
এদিকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউনিভার্সিটি লিবর ডি ব্রাসেলসের (ইউএলবি) বাইরের একটি উঠানে শহীদ মিনারের একটি কাঠামো সঙ্গে করে নিয়ে এসে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের পলাতক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের চার নেতা ও তাদের স্ত্রীরা। একুশের শোকাবহ দিনে উপস্থিত মোট সাত অংশগ্রহণকারীকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেলেও হাছান মাহমুদ ছিলেন বিধ্বস্ত চেহারায়। তার গলার স্বরও ছিল অনুচ্চ। সেখানে তারা ‘একুশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক হও লড়াই করো’সহ কয়েকটি শ্লোগান দিয়ে মোবাইলে ভিডিও তুলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তড়িঘড়ি গাড়িতে ওঠে অন্যত্র চলে যান।

বেলজিয়ামে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন— এমন এক বাংলাদেশি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর থেকে হাছান মাহমুদ তো দূরের কথা, এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও পাবলিক কোনো প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করতে দেখা যায়নি। এখনও তারা অনেকটা আড়ালেই থাকেন। সাধারণ প্রবাসীদের ব্যাপক ক্ষোভ আছে তাদের ওপর।’

ওই প্রবাসী বলেন, ‘ব্রাসেলস থেকে হাছান মাহমুদের বাড়ি প্রায় দেড়শ কিলোমিটার দূরে। তিনি সেখানেই থাকেন। বেলজিয়ামে তার আরও অন্তত চারটি বাড়ি আছে বলে শুনেছি। প্রবাসীদের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে তাকে এখন পর্যন্ত পাবলিক কোনো প্লেসে সেভাবে দেখা যায়নি।’

জার্মানিতেও তোপের মুখে
এর আগে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে আওয়ামী লীগের সভায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েন হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানস্থলে তিনি উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তিনি নীরবে সভাস্থল ছেড়ে যান।

ওই সময় বার্লিন থেকে যাওয়া এক আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনাদের লোভ আর দুর্নীতির কারণেই দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা আজকে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে সবার জীবন। আহত নিহত নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর আপনি রাখেন নাই। যাকে ইচ্ছা তাকে দলে ঢুকিয়েছেন। আপনাদের দুর্নীতির কারণে দল আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা।’

ঢাকা থেকে জার্মানি পালান ২৫ আগস্ট
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, গত বছরের ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছান। সেই থেকে বেলজিয়ামে তিনি লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন।

এর আগে ৪ আগস্ট রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ থেকে পালিয়ে যান। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নেই থাকেন।

হাছান মাহমুদ দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ভাগ্য খুলে যায় হাছান মাহমুদের। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়