শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৬ অক্টোবর, ২০২৪, ০৩:৩১ দুপুর
আপডেট : ২৬ অক্টোবর, ২০২৪, ০৬:০৫ বিকাল

প্রতিবেদক : আশ্রাফুর রহমান রাসেল

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা ও ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা স্থগিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

দুই যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া চুক্তি বাতিলে একটি মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানির মামলায় তাঁদের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল বলে আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল আদালতের বিচারক অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে আদালতে হাজিরের পরোয়ানা জারি করেছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করেছে। গতকাল শুক্রবার পরোয়ানা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী।

কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে মোট ৩১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারের সালিসি ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করছে। বিচারক কার্ল জে. নিকোলস ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন, যেন সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুরকে আদালতে হাজির করার জন্য আটক করা হয়। এই নির্দেশের পরই বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে আপিল করে। 

বাংলাদেশ সরকার ডিসি সার্কিট আদালতকে জানায়, বিচারক নিকোলসের এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কোনো এখতিয়ার নেই। এ ছাড়া, যাঁদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাঁরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিক। তাঁদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা হতে পারে না। সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দায়মুক্তি দেওয়া আছে। 

মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানি স্মিথ কোজেনারেশন গত বুধবার আদালত অবমাননার আবেদন করে। তাদের দাবি, সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বুধবার হাজির হওয়ার নির্দেশ অমান্য করেছেন। স্মিথ কোজেনারেশন আদালতকে জানায়, এই নির্দেশ না পেলে বাংলাদেশ সরকার আদালতের কর্তৃত্বকে অবজ্ঞা করতে থাকবে এবং সাক্ষ্য দেওয়ার নোটিশগুলোর কোনো জবাব দেবে না। 

চলতি সপ্তাহে সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করার কথা।

স্মিথ কোজেনারেশন জানায়, এই সাক্ষ্য নেওয়া তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি কোম্পানির সালিসি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে। 

আবেদনে বলা হয়েছে, প্রদেয় সম্পত্তির অবস্থান সম্পর্কে এ দুই ব্যক্তির ঘনিষ্ঠভাবে জানাশোনা রয়েছে। তাঁরা নিশ্চিতভাবে মূল্যবান তথ্য দিতে পারবেন। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থাগুলোর বাংলাদেশ সরকারকে ৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। 

আবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির বিশ্বাস, এই তহবিলের একটি অংশ সরকারের ঋণদাতাদের ঋণ বা সুদ পরিশোধে ব্যবহৃত হবে। সুতরাং, আবেদনকারীকে অতি দ্রুত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে তহবিল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যেকোনো অধিকার সুরক্ষিত রাখা যায়। 

স্মিথ কোজেনারেশন দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০০২ ও ২০০৩ সালের সালিশি রায়গুলো কার্যকরের চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

এই বিরোধের শুরু ১৯৯৭ সালে, যখন স্মিথ কোজেনারেশন বাংলাদেশ সরকার এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে একটি বার্জ-মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এটি করা হয়েছিল। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। 

স্মিথ কোজেনারেশন ২০০৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসি আদালতে এটি বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করে। সরকার তাদের প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সব অনুমোদন দিতে সম্মতও হয়েছিল বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে। 

তবে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে এবং কোম্পানিকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন কখনোই দেয়নি। এরপর তারা ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন পারফরমেন্স বন্ড গ্যারান্টি ফেরত দেয়, যা স্মিথ কোজেনারেশন সরকারকে দিয়েছিল। 

কোম্পানিটি সেই বছর আইসিসি ট্রাইব্যুনালে সালিশের প্রক্রিয়া শুরু করে। ট্রাইবুনাল পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ১৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার দিতে নির্দেশ দেয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে অতিরিক্ত ৩৯ হাজার ডলার পরিশোধ করতেও বলা হয়। পিডিবি ও বাংলাদেশ সরকারকে আরও মোট ২ লাখ ২২ হাজার ডলার দেওয়ার নির্দেশ দেয় বলে আদালতে দেওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ডিসির ফেডারেল বিচারক ২০০৭ সালে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ পুনর্বহাল রাখেন। সে বছরের মে মাসে স্মিথ কোজেনারেশনের অনুরোধে আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। স্মিথ কোজেনারেশনের আইনজীবী সংবাদমাধ্যম ল ৩৬০কে জানিয়েছেন, সুদ এবং অন্যান্য খরচসহ স্মিথ কোজেনারেশনকে এখন ৩১ মিলিয়নের ডলার বেশি অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ। 

স্মিথ কোজেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করছেন ব্রায়ান এইচ পান্ড্যা, হ্যারল্ড ই প্যাট্রিকফ, জেসিকা ম্যারোকুইন ও প্রিসিলা বান্দেইরা। 

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছেন অ্যান্ড্রু বি. লোয়েনস্টাইন, মার্ক ডি. ফিনস্টারওয়াল্ড, ক্রিস্টিনা জি হিউরাস, নিকোলাস এম রেন্জলার এবং জেমস এম গ্রস। 

এই মামলা স্মিথ কোজেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য নামে আদালতে নথিভুক্ত। মামলা নম্বর 1: 06-cv-01827। ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ায় এই মামলা করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে সম্প্রতি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক একটি চুক্তি বাতিলের দায়ে স্মিথ কোজেনারেশন ক্ষতিপূরণ দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করে। ১৯৯৭ সালে স্মিথ কোজেনারেশন তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে একটি বার্জ-মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য অনুমতি প্রদান করেছিল সরকার।

এই মামলায় দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর ওয়াশিংটন ডিসি সার্কিট কোর্ট অনেকটা এখতিয়ারবহির্ভূত একটি রায় প্রদান করে, যা আজ শুক্রবার আদালত কর্তৃক স্থগিত করা হয়। যদিও বিষয়টির সাময়িক অবসান ঘটেছে, তবে লুটেরা সরকারের দায় রক্তস্নাত বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের সেই সময়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে এবং বিষয়টি বর্তমান সরকারের নজরে না এনে ধামাচাপাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়