এম. মোশাররফ হোসাইন: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে একটি বিশ্লেষণধর্মী কলাম লিখেছেন ব্লুমবার্গের কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি। সেখানে বাংলাদেশের প্রশংসা করে এর মাথাপিছু আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বেশি উল্লেখ করে বর্তমান রিজার্ভ সংকট নিয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারীর মাঝামাঝি সময়ে এবং স্বাধীন হওয়ার ঠিক ৫০ বছর পর বাংলাদেশ একটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। প্রকৃতপক্ষে এর মাথাপিছু জাতীয় আয় এখন পাশের ভারতের তুলনায় বেশি। কিন্তু আকস্মিক নিষ্ঠুর ধাক্কায় বাংলাদেশের এ উদযাপন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ডলার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ চেয়েছে।
এই অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বাংলাদেশকে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তোরণে লাইনচ্যুত করবে কিনা। প্রতিবেশী ভারত থেকে বাংলাদেশ কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনার সূত্র পেতে পারে এবং শিক্ষা নিতে পারে।
অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে প্রায় প্রতিটি স্বল্পোন্নত দেশে আর্থিক সংকট তৈরি হয়। ভারতেও এমনটি হয়েছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৯৯০-৯১ সালে আমদানির জন্য ডলার সংকট তৈরি হয়েছিল। ওই সময় দিল্লিকে আইএমএফের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তখন ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ৩৯০ ডলার। মাত্র ১০ ডলার বৃদ্ধি অর্থাৎ ৪০০ ডলারের জন্য ভারতকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
অর্থনীতির জন্য দুর্বল বছরকে সংস্কারের কাজে ব্যবহার করতে হবে যেটা অর্থনীতিকে নতুন করে প্রবৃদ্ধি দেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা করেছিল তা হলো, ব্যবসায় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করা, শিল্পে লাইসেন্স ছাড় করা এবং বৈশ্বিক মূলধনে স্থানীয় শিল্প শুরু করা। এসব উদ্যোগ ভারতের মাথাপিছু আয় চারগুণ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছিল। ১৯৯৬ সালে যেখানে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ৪০০ ডলার, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫শ ডলার।
ভারত যখন গতি হারাচ্ছিল, বাংলাদেশ তখন উড়ছিল। এক দশক আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলারের কিছু বেশি ছিল, সেখানে গতবছর সেটা বেড়ে ২৬শ ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। বাংলাদেশের প্রকৃত জীবনযাত্রার মান, মুদ্রাস্ফীতির সামঞ্জস্যতা এবং মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতা এখনও ভারত থেকে ৪ শতাংশ বেশি।
প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকায় ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে যে তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমে ৪০ বিলিয়ন হয়েছে, যা প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে পারে। তিন মাসের কম সময়ের আমদানি ব্যয়ের রিজার্ভ বিপজ্জনক বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আইএমএফের কাছ থেকে অগ্রিম ঋণ চাইছে বলে মনে হচ্ছে। আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতি সংস্কারে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
আইএমএফের ঋণ সম্পর্কে ঢাকা-ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ব্লুমবার্গ নিউজকে বলেছেন, ‘সুযোগ গ্রহণ করা উচিত’। তবে প্রতিবেশী ভারত থেকে নীতি নির্ধারণীদের বড় শিক্ষা হবে, ব্যাপকভিত্তিক মজুরি বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির সুযোগ হাতছাড়া না করা।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে টেক্সটাইল রপ্তানি ১ হাজার গুণ বৃদ্ধি করে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির ক্লাব ছেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের একটি দুর্দান্ত কীর্তি।
উচ্চ-মধ্যম আয়ের মর্যাদা পেতে, বাংলাদেশিদের গড় আয় ৬০ শতাংশের বেশি বাড়াতে হবে। এর ফলে শিল্প ও অবকাঠামোর জন্য ঋণের প্রয়োজন হবে। ভারত এই সমস্যাটিকে খুব বেশি দিন ধরে রেখেছিল। বাংলাদেশ যেন ভুলের পুনরাবৃত্তি না করে।
লেখক: অ্যান্ডি মুখার্জি, ব্লুমবার্গ’র এশিয়া অঞ্চলের শিল্প ও আর্থিক পরিসেবা-বিষয়ক কলামিস্ট।
আপনার মতামত লিখুন :