শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৪ মার্চ, ২০২৫, ১২:৪৪ দুপুর
আপডেট : ১৫ মার্চ, ২০২৫, ০১:৪৩ রাত

প্রতিবেদক : মহসিন কবির

ফের ভারতের মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার, ভিত্তিহীন এসব খবরে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান

মহসিন কবির: সম্প্রতি দ্য ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডেসহ ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরদ্ধে ফের অপপ্রচারে নেমেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফেক নিউজ করে ভারতের ডিমিয়া এ তকমা পাওয়ার পরও অপপ্রচারে থেমে নেই। কি কারণে এতো অপপ্রচার চালাচ্ছে তা বাংলাদেশের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। আসলে ভারত কি চায়। নাকি টাকা দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক ঘাচ্ছে শোশ্যাল মিডিয়ায়।  

ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা শুধু ভিত্তিহীনই নয়, গভীরভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনও বলে মন্তব্য করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জারি করা একটি প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এ ধরনের মিথ্যা তথ্য প্রচার জাতীয় অবহেলা এবং বিদেশি বিষয়েও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যে মৌলিক নীতি রয়েছে, তা ক্ষুণ্ণ করে। পাশাপাশি এটি সংশ্লিষ্ট মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাকেও ক্ষুণ্ণ করে।'

বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে : কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস। অর্থাৎ যথাসময়ে যথাযথ কাজটি করতে না পারলে পরে পস্তাতে হয়। ৫ আগস্ট অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারতের ভেতর থেকে কতিপয় মিডিয়া একতরফাভাবে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার করলেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

এক সপ্তাহ ধরেই ভারতের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে স্পর্শকাতর খবর প্রচার করা হয়েছে। অনেকে এসব প্রচারকে সংবাদ বলতে নারাজ, তারা এগুলোকে তথ্য সন্ত্রাস হিসাবে অভিহিত করছেন। তবে এক সপ্তাহ ধরে এসব রটনা এবং রং মাখানো গল্পের ছড়াছড়ি দেখা গেলেও আইএসপিআরের টনক নড়েছে অনেক পরে। মঙ্গলবার রাতে তারা এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবাদ পাঠিয়েছে গণমাধ্যমে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আজতক বাংলা নামের একটি টিভি চ্যানেল ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে গুজব প্রচার করছে। কয়েকদিন ধরে প্রচারিত আজতক বাংলার শিরোনামগুলো ছিল এ রকম : ক. ৭২ ঘণ্টা আগেই ফাঁস, জাতিসংঘ ঢুকে বাংলাদেশ সেনাপ্রধানকে খতম করবে। খ. ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে সেনা নামাবো, ইউনূসের ঘরে সেনাপ্রধানের আলটিমেটাম।

সেনাপ্রধান নিঃশব্দে গভীর রাতে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ঘটালেন? ঘ. বাংলাদেশি সেনার ভেতরেই ধামাকা! রেগে কাকে সরালেন ওয়াকার? ঙ. নিঃশব্দে ঢাকায় ঢুকে গেল ইন্ডিয়া, আর্মির সাপোর্টে দিল্লির কন্ট্রোলে দেশ? চ. ট্রাম্পের গ্রিন সিগন্যাল, বাংলাদেশ আর্মি দেশে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় আনছে। ছ. হাসিনার ফেরার তারিখ পাকা, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে ফিরছেন মুজিবকন্যা।

এই অব্যাহত অপপ্রচারের পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে সবার উদ্দেশে এক সতর্কবার্তা দেন। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি, মারামারি, কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে বলে সবাইকে সতর্ক করেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

তিনি বলেন, নিজেরা হানাহানিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। তাই এগুলো বন্ধ করে তিনি সবাইকে একসঙ্গে থাকার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। এ বক্তব্যের পর এর মধ্যে অনেকে ইতিবাচক-নেতিবাচক নানা উপাদান খুঁজতে শুরু করেন। অনেকে এটিও বলেন, সেনাপ্রধান এভাবে প্রধান উপদেষ্টাকে নাম ধরে সম্বোধন করতে পারেন না। তাছাড়া তাদের মতে, সেনাপ্রধান জাতিকে সতর্কতা দেওয়ার কে? ফলে সম্বোধন ইস্যুতে অনেকে মনে করছে, সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি দ্বন্দ্ব রয়েছে। আর এ সুযোগটি লুফে নিয়েছে ভারতীয় মিডিয়া।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ১৩ মার্চ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস বাংলাদেশে এসেছেন। এটা একটা বড় ব্যাপারই বটে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন যে আছে জাতিসংঘের, এ সফর তার দুর্দান্ত প্রমাণ হিসাবেই উপস্থাপন করবে। এর আগেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে জুলাই গণহত্যার ওপর তদন্ত করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। সেই তদন্তে হাসিনার নৃশংসতা ও ভয়াবহতা উঠে এসেছে। তার নির্দেশেই জনগণকে হত্যার প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ডকুমেন্ট।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস বৃহস্পতিবার চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতিসংঘ মহাসচিব শুক্রবার ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তারা দুজনে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে একসঙ্গে কক্সবাজার যাবেন। সেখানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার করবেন।

গুতেরেসের সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে তিনি রমজান মাসে সংহতি জানাতে বাংলাদেশে আসছেন। প্রতিবছর তিনি রমজান মাসে মুসলিম দেশগুলোতে সফর করে থাকেন। এ সফরে তিনি রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা করবেন। সেখানে আন্তর্জাতিক সহায়তার বিষয়টিও উঠে আসবে।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে সংস্কার, নির্বাচন এবং জাতিসংঘের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে কি না, জানতে চাইলে গোয়েন লুইস বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের সময়ে বাংলাদেশিদের পাশে থেকেছে। ফলে জাতিসংঘের সহযোগিতা ও সংহতি চলবে। কী ধরনের সহযোগিতা চাওয়া হবে এবং অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো কী, তা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বা ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার জাতিসংঘকে জানাবে।

তৃতীয়ত, আগামী ২৬ মার্চ চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, কূটনীতি, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সফর। বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, এ সফরের মাধ্যমে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন।

উপরোক্ত প্রথম বিষয়টি অর্থাৎ জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সতর্কবার্তাকে ফায়দা হাসিল করার একটি উপাদান হিসাবে নিয়েছে ভারতের কতিপয় মিডিয়া। তারা মূলত বাংলাদেশ ইস্যুতে বিজেপি সরকারকে খানিকটা স্বস্তি দিতে এ অপকর্মের পথ বেছে নিয়েছে। এর বাইরে জাতিসংঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তিতে আছে ভারতের বিজেপি সরকার।

সুতরাং এসব তৎপরতার বিপরীতে পরিকল্পিত অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতরে সামান্যতম উত্তেজনাও যদি ছড়ানো যায়, তাহলে ফায়দা হাসিলের নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে। এজন্য টার্গেট করেছে মার্চের বর্তমান সময়টিকে। কারণ দুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। সুতরাং সারা বিশ্বে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য তাদের কাছে এ সময়টাই যথার্থ। তাছাড়া নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে একটি গ্রুপ ১৫ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে একটি পরিকল্পিত মব তৈরিরও চেষ্টা করছে বলে জানা যাচ্ছে।

কয়েক দিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদি বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। নিয়মিত নোটও আদান-প্রদান করে দুই বাহিনী। এ দাবি যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ, তা একটু গভীরে ঢুকলেই বোঝা যায়। ওই বক্তব্যে ভারতীয় সেনাপ্রধান নির্বাচিত সরকার এলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন।

তাহলে, এসব মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি এটাই বোঝাতে চাইলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের সঙ্গে ভারতের বিজেপি সরকারের এ মুহূর্তে ভালো সম্পর্ক না থাকলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক আছে। তার মানে, প্রচ্ছন্নভাবে এটাও তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটা দূরত্ব বা দ্বন্দ্ব আছে। আসলে কি তাই?

ধরুন ঘটনা যদি সত্যিই হয়, তাহলে ভারতের সেনাবাহিনীর তো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে কেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্যু ও প্রতিবিপ্লবের নানা আজগুবি সংবাদ ভারতের অভ্যন্তর থেকে প্রচার করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি উসকে দেওয়া হচ্ছে? বরং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীর উষ্ণতা থাকলে তো রাষ্ট্রীয়ভাবেই ভারতের সরকার এসব অপপ্রচার দমনে ব্যবস্থা গ্রহণ করত।

সময়টা খুবই স্পর্শকাতর। এ সময়ে শুধু বাংলাদেশের সরকার নয় বরং জনগণকেও খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ সংস্থাকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি করার মানে হলো, অন্যের তৈরি করা ফাঁদে পা দেওয়া। একটা পক্ষ চাচ্ছে, আমাদের গর্বের এ প্রতিষ্ঠান দুর্বল হোক। হ্যাঁ সেনাবাহিনীর ভেতরের দুর্বলতাগুলোকে দূর করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি যে কোনো নাগরিক করতেই পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভারতীয় মিডিয়া কর্তৃক এ ধরনের নগ্ন, ন্যক্কারজনক ও গোয়েবলসীয় অপপ্রচারের ফাঁদে পা দেওয়া মানেই হলো আত্মহত্যার শামিল। আমরা যেন এ বিষয়টি ভুলে না যাই।

এর বাইরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংকে অবশ্যই অপপ্রচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি অপপ্রচার ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেস ব্রিফিং করে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে হবে, প্রতি ঘণ্টায় দেশি-বিদেশি মিডিয়াকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে; বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়াকে নজরদারির আওতায় এনে এর উপযুক্ত তাৎক্ষণিক জবাব দিতে হবে, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত আপডেট তথ্য দিতে হবে, বিদেশি দূতাবাসগুলোর কাছে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক চিত্র তুলে ধরার ব্যবস্থা করতে হবে; প্রয়োজনে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা করে পুরো বিশ্বের সামনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়