২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষুব্ধ জনতা প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য গুরুতর সহিংস হামলায় লিপ্ত হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, প্রকৃত বা ধারণাকৃত সমর্থক, পুলিশ ও আওয়ামীপন্থী হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যমকে লক্ষ্য করে এসব সহিংসতা চালানো হয়। এতে আওয়ামী লীগের ১৪৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে স্বাধীনভাবে তদন্ত পরিচালনার পর এক প্রতিবেদনে এমনটি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। গত জুলাই-আগস্ট মাস পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বারা সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আন্দোলনের মধ্যে কিছু সহিংস গোষ্ঠী প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু করে। ১৯ জুলাই উত্তরায় গাজীপুরের সাবেক মেয়রকে গণপিটুনি দেওয়া হয় এবং তাঁর এক সহযোগীকে হত্যা করা হয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগে এ ঘটনা ঘটে।
৪ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখানে পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতা ও একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। একই দিনে এনায়েতপুর স্টেশন আক্রমণের ঘটনায় ১৫ পুলিশ সদস্য নিহত হন।
গত ৫ আগস্ট ফেনীতে বিক্ষুব্ধ জনতা তিনটি থানায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় এবং ১৬ জন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর আক্রমণ করে। এর আগের দিন ৪ আগস্ট একই জেলায় ৩০০-৪০০ জন আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র-বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। এতে ৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত ও ৭৯ জন গুরুতর আহত হয়।
রংপুরে একজন আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর ও তাঁর এক সহযোগীকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। নরসিংদীতে ৬ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধাওয়া করে হত্যা করা হয়, যারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর দেশজুড়ে প্রতিশোধমূলক হামলা বেড়ে যায়। পুলিশের ৬৩৯টি স্টেশনের মধ্যে ৪৫০টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাভার, সিলেট, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে থানা আক্রমণের ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত জনতা যাত্রাবাড়ী থানায় পেট্রলবোমা দিয়ে হামলা করে। এতে দুজন র্যাব কর্মকর্তাসহ চারজন আনসার ও পুলিশ সদস্য নিহত হন। উত্তরা থানায় চার পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয় এবং আশুলিয়ায় তিনজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। ঢাকার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ীতে আওয়ামী লীগের কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। যশোরে একটি হোটেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যেখানে ২৪ জন নিহত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী, কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকেরাও এসব সহিংসতায় জড়িত ছিল। বিএনপি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে, তাদের কিছু স্থানীয় নেতা-কর্মী, বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সংগঠনের সদস্যরা প্রতিশোধমূলক সহিংসতায় অংশ নিয়েছিল। ১০ আগস্ট বিএনপি সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৪ জন স্থানীয় নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করে।
১৪ আগস্ট বিএনপি-সমর্থিত ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি কারখানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, যেখানে শ্রমিকদের মারধর করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
এক ঘটনায় বিএনপির সমর্থকেরা এক সিনিয়র যুবলীগ নেতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে তাঁর বাবা-মাকে জিম্মি করে। এরপর স্থানীয় এক বিএনপির নেতা মুক্তিপণ আদায় করেন। পরে বিএনপির কর্মীরা ওই নেতার ব্যবসা দখল করে নেয়। এ ঘটনায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে ভুক্তভোগীর পরিবারের এক সদস্যকে আক্রমণ করা হয়।
যশোরে এক আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন একটি হোটেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে প্রায় ২৪ জন নিহত হয়। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় সমর্থকেরা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে লুটপাট ও পেট্রলবোমা হামলার ঘটনাও ঘটে।
গণমাধ্যমের ওপর হামলা ও সাংবাদিক নির্যাতন
আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ও সাবেক সরকারের সমর্থক হিসেবে বিবেচিত সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও চালানো হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার কিছুক্ষণ পর সংক্ষুব্ধ জনতা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা চালিয়ে তা পুড়িয়ে দেয় বা ভাঙচুর করে।
৩ আগস্ট একাত্তর টিভিতে লাঠিসোঁটা ও পাথর হাতে সশস্ত্র একদল লোক হামলা চালায়, যারা অন্যান্য বিক্ষোভকারীর চেয়ে আলাদা ছিল। ৫ আগস্ট কয়েক শ লোক একাত্তর টিভিতে আবারও হামলা ও ভবনে ঢুকে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করে।
সময় টিভিও আক্রমণের শিকার হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ে একদল লোক সেখানে হামলা চালিয়ে ভবনে আগুন দেয়। এটিএন নিউজ টিভিতে হামলাকারীরা দুই সাংবাদিক ও আরও দুই কর্মীর ওপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করে, পাশাপাশি অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
৫ আগস্ট এটিএন বাংলা, ডিবিসি নিউজ, মাই টিভি, বিজয় টিভি ও গাজী টিভির দপ্তরেও হামলার ঘটনা ঘটে। ৭ আগস্ট প্রায় ২০০ জনের একটি দল আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিএনপির স্লোগান দিতে দিতে মোহনা টিভির ভবনে জোরপূর্বক প্রবেশ করে। তারা একজন সিনিয়র সাংবাদিককে মারধর করে এবং ভবন ধ্বংস বা আগুন না লাগানোর শর্তে চাঁদা আদায় করে।
একাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিককে এসব মামলার ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এই মামলাগুলো সাজানো বলে উদ্বেগ রয়েছে।
অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ২১ নভেম্বর এক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার করেন, হত্যা মামলাগুলো ‘দ্রুতগতিতে, পুরোনো আইন ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে’ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আইনের আওতায় ভুক্তভোগীরাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এবং এতে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সরকার আরও জানায়, তদন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে।
৫ আগস্টের পর থেকে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের পর্যবেক্ষকদের মতে, উল্টো ধরনের ভয়ভীতি ছড়ানোর একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন গণমাধ্যমকর্মীরা আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে বা বিরোধী দলের সমালোচনা করতে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
নারীদের ওপর সহিংসতা
আগস্ট মাসে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ সদস্য এক নারীকে দুই ব্যক্তি আটকায়। বয়স ও পোশাক দেখে তাঁদের ছাত্রদের মতো মনে হয়নি। তাঁরা ওই নারীকে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য করে, তাঁর পোশাক ধরে টান দেয়, গালে চড় মারে এবং বুকে ঘুষি মারে। কয়েক দিন পর ওই নারীর ওপর আরও ভয়াবহ হামলা হয়। একদল লোক তাঁকে ঘিরে ফেলে তাঁর পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ধর্ষণ করে। শুধু তা-ই নয়, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসাও দেওয়া হয়নি।
অন্য কয়েকটি ঘটনায় নারী আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সমর্থকদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। এসব সরাসরি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওএইচসিএইচআর মনে করে, বাস্তবে লৈঙ্গিকভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা আরও বেশি ঘটেছে, তবে সবকিছু নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আন্দোলনের পর অনেক নারীনেত্রী ও পরিচিত কর্মী হুমকির মুখে পড়েন এবং প্রতিশোধমূলক হামলার ভয়ে মুখ ও চুল ঢেকে রাখতে বাধ্য হন।
আওয়ামী লীগের তথ্য অনুসারে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। ৫ আগস্ট এক দিনেই ৬৮ জন নিহত হন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহত হন এবং ২ হাজার ৩০৮ জন আহত হন। সূত্র : আজকের পত্রিকা
আপনার মতামত লিখুন :