ফয়সাল চৌধুরী, কুষ্টিয়া: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদর ৩ আসনের সাংসদ মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, সাইঁজি'র আমরা দুইটা অনুষ্ঠান করে থাকি। এটি লালন স্মরণোউৎসব উৎসব আর একটি হচ্ছে লালন তিরোধান দিবস। এখানে লালনের অনেক আলোচনা হয়। লালনে অনেক গান হয়। রাত জেগে আমরা শুনি। কিন্তু এর মর্ম আমরা কতটুকু ধারণ করতে পারছি। আলোচনা সভা ও গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি।
তিনি বলেন, লালনের যে বাণী এবং দর্শন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এখানে আপনারা হাজার হাজার লালনের ভক্তরা আছেন। আপনি এখান থেকে লালনের যে বাণী নিয়ে ধারণ করছেন। লালনের দর্শনগুলা জানছেন। এগুলো যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে না দেন, আমাদের এই আলোচনা শুধু আলোচনার মধ্যেই রয়ে যাবে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন অ্যাকাডেমির আয়োজনে শনিবার (৪ মার্চ) রাত পৌনে নয়টার সময় তিনদিন ব্যাপি বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের স্মরণোৎসব-২০২৩ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
হানিফ বলেন, আজকে আমাদের সমাজের মধ্যে চরম নৈতিকতার অবক্ষয়ে চলে গেছে। মানুষের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ নেই। আস্থা নেই, মানুষের নীতি নৈতিকতার, সততাও আস্তে আস্তে শেষ প্রান্তে চলে আসছে। এরকম একটা নিতি নৈতিকতার অবক্ষয়ের দিকে এই জাতি কখনো দেশপ্রেম হতে পারে না। অথচ আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। উনি (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) যে দর্শন নিয়ে সেই দর্শনের সাথে আজকে যে এই আমাদের মামনি সাধক লালন শাহের দর্শনের অদ্ভুত মিল পায়। সেই দর্শন আমরা ধরে রাখতে পারি নাই। আমরা আলোচনা করি কিন্তু আমরা সেই আলোচনার সব ধারণ করিনা। তাহলে আলোচনা করে কনো লাভ নেই। লালন শাহ বলেছেন ‘মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হবি।’
হানিফ এমপি আরো বলেন, মানুষ ভোজলে যদি সোনা মানুষ হবে। আমরা যে জ্ঞান অর্জন করে, লালনের দর্শন ধারণ করে, আমরা সুফিজন দর্শন ধারণ করে, সোনার মানুষ হতে চাই কিন্তু সেটা হচ্ছে কোথায়। আমরা। চারিদিকে যে অনৈতিকতা দেখি। সেই সোনা মানুষ কোথায় হচ্ছি আমরা।
আসেন আমরা শুধু গান এবং আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে। লালন শাহের দর্শন, তার সুফিবাদের দর্শন ধারণ করে আমরা প্রকৃত আদর্শ মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলি। আজকে সমাজকে সেই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রেরণা দি, সাহস দি, শ্রদ্ধা করি তাদেরকে, উদ্বুদ্ধ করি,এটাই হোক আজকের আমাদের সকলের অঙ্গীকার। এইসব সুফিবাদের প্রতি প্রতি আমাদের সমর্থন। তাহলে লালন শাহসহ যারা এই সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাদের যে সমস্ত চিন্তা চেতনা ধ্যান-ধারণায় যে মহান বাণী রেখে গেছেন। তাদের কষ্টটা সার্থক হবে, সমৃদ্ধ হবে।
তিনদিন ব্যাপি বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের স্মরণোৎসব-২০২৩ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে লালন একাডেমির মূল মঞ্চে আলোচনা সভায় লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে এসময় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আ.কা.ম. সরওয়ার জাহান, বিজ্ঞ পিপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী, নাগরিক কমিটির আহবায়ক ডা.এস. এম মুস্তানজিদ, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাব (কেপিসি) সভাপতি হাজী রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব প্রমুখ। প্রথম দিনের প্রধান আলোচক ছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো.শানিনুর রহমান। আলোচক ছিলেন লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহ।
আলোচনা শেষে মূল মঞ্চে একাডেমির শিল্পীরা লালন ফকিরের আধ্যাত্মিক গান পরিবেশন করেন।
এদিকে এবার শবে বরাতের কারণে দুদিন এগিয়ে আনা হয়েছে অনুষ্ঠানমালা। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র গান, বাউল মেলা ও সাধুসংঘের মধ্য দিয়ে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে আলোচনা সভা শুরু হয়েছে। ভক্ত অনুসারীরা এক সপ্তাহ আগে থেকেই লালন আখড়ায় জায়গা করে নিয়েছে। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আখড়াবাড়ির প্রাঙ্গন ধুয়ে মুছে সাফ করে এক বর্ণিল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে লালন একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
মরমী এ সঙ্গীত সাধকের স্মরণোৎসব উপলক্ষে তাঁর সাধন-ভজনের তীর্থ স্থান ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গন পরিণত হয়েছে এখন উৎসবের পল্লীতে। দেশ-বিদেশ থেকে এখানে আগমন ঘটেছে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজন'সহ অসংখ্য মানুষের। ৪ মার্চ থেকে উৎসব শুরু হলো, চলবে ৬ মার্চ পর্যন্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে স্মরণোৎসবে থাকবে লালনের স্মৃতিচারণ করে আলোচনা, লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান ও লালন গ্রামীণ মেলা।
কুষ্টিয়া শহরের কোল ঘেষে কুমারখালী উপজেলার কালীগঙ্গা নদী। এ নদীর তীরেই ছেঁউড়িয়ার লালন সমাধি। বাংলা ১২৯৭’র পহেলা কার্তিক ও ইংরেজী ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ সালে এখানেই মরমী সাধক লালন শাহ’র শেষ শয্যা রচিত হয়। গবেষকদের মতে, বাউল সাধক ফকির লালন শাহ’র জীবদ্দশায় দোল পুর্ণিমা উপলক্ষে পালন করা হতো দোল উৎসব। আর দোল পুর্ণিমাকে ঘিরেই বসতো সাধু সংঘ লালনের সেই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় লালন একাডেমীও প্রতিবছর এ উৎসবটিকে 'লালন স্মরণোৎসব' হিসাবে পালন করে আসছে।
তবে লালন অনুসারীরা দিনটিকে 'দোল পূর্ণিমা' উৎসব হিসাবেই পালন করে থাকেন। সাধুদের মতে, সত্যিকার অর্থে লালন অনুসারীরা দোল পূর্ণিমার এ রাতটির জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। সাঁইজির রীতি অনুসারে দোলপুর্ণিমার রাতের বিকেলে অধিবাসের মধ্য দিয়ে ২৪ ঘণ্টার দোলসঙ্গ শুরু হয়। চৈত্রের পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার ছটায় আর মাতাল হাওয়ায় গানে গানে বাউল সাধকরা হারিয়ে যায় ভিন্ন কোনো জগতে। পরের দিন চারটায় ‘পুণ্যসেবা’ দিয়ে সাধুসঙ্গ শেষ করে আখড়াবাড়ি ত্যাগ করেন বেশির ভাগ সাধু।
প্রকৃত সাধুসঙ্গের অধিবাস শেষ হলেও লালন একাডেমি আয়োজিত মূল মঞ্চে লালনগীতি ও লালনমেলা চলে আরও দু'দিন। তারা মনে করেন, মানবধর্মই বড় ধর্ম। একসাথে এভাবে সাধুসঙ্গ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধু-গুরুর কৃপা ছাড়া মানুষ মুক্তি পেতে পারে না। তার কৃপায় মানুষ সঠিক পথ দেখে। লালন স্মরনোৎসব ঘিরে কালীগঙ্গা নদীর ধারে প্রতিবছরই বসে জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল গ্রামীণ মেলা।
মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, ‘কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াতেই ছিল ফকির লালন সাঁইজির প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তার প্রয়াণ হয়। বর্তমানে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে লালন অ্যাকাডেমি। এখানে ১৯৬২ সালে সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে।’
প্রতিনিধি/এনএইচ
আপনার মতামত লিখুন :