শহীদুল ইসলাম: রাজধানীর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। এবারের মেলায় শুরুর দিকে দর্শনার্থীর তুলনায় বই বিক্রি কম হলেও শেষ দিকে এসে পাল্টে যায় মেলার দৃশ্যপট। স্টলগুলোতে দেখা যায় তালিকা হাতে পাঠকদের ভীড় ও বই কেনার দৃশ্য।
দীর্ঘদিন করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কাগজ-কালির দাম বৃদ্ধির ফলে এবারে বইয়ের দামও একটু বেশি ছিলো। মেলা শেষে প্রকাশকরা যখন লাভ-লোকসানের হিসাব মিলাচ্ছিলো তখন অনেক প্রকাশকের চেহারাতেই হতাশার ছাপ চোখে পড়ে। প্রকাশকদের মতে এবার কিছু কিছু প্রকাশনীর কাঙ্খিত চাওয়া পূরণ হয়নি, হাতে গোনা কয়েকটা প্রকাশনীর প্রত্যাশা অনুযায়ী বই বিক্রি হয়েছে। মেলাতে প্রচুর মানুষ এলেও বইয়ের বিক্রি আশানুরূপ হয়নি।
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের মেলায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গতবছর এ বিক্রির পরিমান ছিলো ৫২ কোটি টাকার বেশি। এবছর মেলায় নতুন বই এসেছে মোট ৩ হাজার ৭৫০ টি। প্রকাশকরা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও গল্প-উপন্যাস ও সায়েন্স ফিকশনের বই বেশি বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি অনুপ্রেরণামূলক বইয়ের বিক্রিও বেশ ভালো ছিল।
মঙ্গলবার মূলমঞ্চে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সমাপনী অধিবেশনে বইমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি এ বছরের মেলায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রির কথা জানান। গতবছর এ বিক্রয়ের পরিমান ছিলো ৫২ কোটি টাকার বেশি। তবে বাংলা একাডেমির এই তথ্যে বই বিক্রির প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি বলে মনে করেন পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, কিসের ভিত্তিতে বাংলা একাডেমি এই তথ্য দেয় জানি না। অনেক প্রকাশকরাই ফিগারের সঙ্গে একমত না।
এদিকে মাসব্যাপী পুরো মেলায় আলোচিত ছিলো ভিন্ন মতের লেখকদের বই নিয়ে, আলোচনা হয় বই মেলায় স্পন্সরশিপ থেকে কতটাকা আসে, বাংলা একাডেমি জানেনা তা নিয়ে। এছাড়া শিশুদের কাছে জনপ্রিয় শিুশু লেখিকা রাইদাহকে নিয়েও, ১২ বছর বয়সী ছোট্ট রাইদাহর গত বছরের ১ ডিসেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই সে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে নাম করেছিল। রাইদাহর কাছে পাণ্ডলিপি চেয়ে নিয়ে বই প্রকাশ করতেন প্রকাশকেরা। এবারের অমর একুশে বইমেলাতেও রাইদাহ গালিবার ‘ভয়ংকর গাছ’ নামের একটি রূপকথার গল্পের বই এসেছে। এটি তার চতুর্থ বই। রাইদাহর ছাপা বইটি দেখে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, তার চিকিৎসায় অবহেলা করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক।
ভিন্ন মতের বই নিয়ে মেলায় পাঠকরা বলেন, ‘ভিন্ন মতের প্রকাশক ও লেখকদের মাঝে রাজনৈতিক বিরোধিতা না হওয়াই উচিত। কোনো কারণেই ভিন্ন মতের কোনো লেখকের লেখা বই নিষিদ্ধ করা উচিৎ না, যদি তার মধ্যে সৃজনশীলতা থাকে। এছাড়া এবছর মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়েও অনেক প্রকাশক প্রশ্ন তোলেন, তাদের অভিযোগ এবারের মেলাতে ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিলো। তবে বাংলা একাডেমির পরিচালক অভিযোগ আমলে নিয়ে আগামী বছরের মেলা আরো সুশৃঙ্খলভাবে করার কথা জানিয়েছেন।
বইমেলার আয়োজকরা জানান, একুশে বইমেলার জন্য আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয় না সরকার। স্পন্সরশিপ, স্টল ভাড়া এবং বাংলা একাডেমির বার্ষিক বাজেট থেকে পাওয়া অর্থে মেলার ব্যয় মেটানো হয়। আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে স্টলের অবকাঠামো, প্রবেশদ্বার, মূল মঞ্চ নির্মাণসহ সংশ্লিষ্ট কিছু কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে, মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির কাছে অবশ্যই স্পন্সর থেকে আয়ের হিসাব থাকা উচিত।
বইমেলার জন্য সরকারের তরফ থেকেও আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে রামেন্দ্র মজুমদার বলেন, একুশের চেতনাকে ধারণ করে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সরকার আলাদা একটা বরাদ্দ দিতে পারে। ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা হলে তো মেলায় আর বেসরকারি খাতের স্পন্সর দরকার হয় না।
মঙ্গলবার মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও মানসম্মত সর্বাধিক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়। গুণগত মান বিচারে ২০২২ সালে প্রকাশিত সেরা বই বিভাগে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ পেয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান, এগুলো হলো আহমদ রফিক রচিত 'বিচ্ছিন্ন ভাবনা' প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুক্স, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত 'বাংলা একাডেমি, আমার বাংলা একাডেমি' বইয়ের জন্য ঐতিহ্য। এছাড়া হাবিবুর রহমান রচিত 'ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা' বইয়ের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড পুরস্কার জয়ী হয়।
২০২২ সালের প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশে ময়ূরপঙ্খি প্রকাশনী পায় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩।
সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাপনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মেলার বাংলা একাডেমির পরিচালক মুহাম্মাদ নূরুল হুদা বলেন, এবারের মেলা আমরা অত্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার চেষ্টা করেছি, মেলাতে বিভিন্ন প্রকাশনী যে বিশৃঙ্খলাগুলোর অভিযোগ করেছেন আশাকরি আগামী বছর এগুলো আমলে নিয়ে মেলা আরো বেশি সুশৃঙ্খল হবে।
এসআই/এসএ
আপনার মতামত লিখুন :