আনোয়ার হক: ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেম, পরিণয় সবসময় এক সুতোয় গাঁথা হয় না। কিম্বা বলা চলে এক সুতোয় গাঁথা হয়ে ওঠে না সবার বেলায়। তাই বলে পরিণতি না পাওয়া সেই অব্যক্ত অনুভূতি মরেও বেঁচে থাকে মনের মণিকোঠায়। জীবনের চতুর্থ ধাপে এমনই এক ভালোলাগা অভাবনীয় এক অবয়বে সৌধের মত দাঁড়িয়ে আছে প্রেমের বধ্যভূমিতে।
দেশের বৃহত্তর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে অবসরে আসা একজন বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক যার এবং আমর বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে। একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমরা। চার ক্লাস সিনিয়র ছিলেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ এবং নিরবিচ্ছিন্ন। ঢাকার একটি অভিজাত প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হসপিটালে তাঁর প্রাইভেট চেম্বার। রোগী দেখাতে কয়েক সপ্তাহ আগে নাম লিখাতে হয়। কিন্তু আমার বেলায় সব নিয়মকানুন শিথিলযোগ্য।
ব্যক্তিগত পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাতের বাইরে বছরে দুইবার রুটিন চেকআপের জন্যে যাই তাঁর চেম্বারে। রুটিন মাফিক তিনি মোবাইল ফোনে টেস্টের লিস্ট পাঠিয়ে দেন। সে অনুযায়ী টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করি। অন্যান্য রুগীর চেয়ে তিন চার গুন সময় বেশি দেন আমার বেলায়। এ সময়ের আলোচনায় স্বাস্থ্য বিষয় ছাড়াও এলাকার গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর বিনিময় এবং আমার ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা ইত্যাদি নিয়েও কথা হয়।
গতকাল গিয়েছিলাম ডাক্তার সাহেবের কাছে। ওয়েটিং লাউঞ্জের ভেতর দিয়ে চেম্বারের দরজার দিকে যেতেই চোখ আটকে গেল এক নারী মুখ নজরে আসতেই। থমকে দাঁড়ালাম বোধহয়। আমি মুখ খোলার আগেই সে সোফা থেকে উঠতে উঠতে কাঁপা গলায় বললো, ভাল আছো? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ডাক্তার চাচা বললেন যে তুমি আসবে আজ। যাও... দেখা করে এসো, আমি বসছি।
চেম্বারে ঢুকতেই ডাক্তার সাহেবের প্রশ্ন, সুরভীর সাথে দেখা হলো? তুমি আসবে শুনে বলেছিল তোমার সাথে দেখা করতে অপেক্ষা করবে।
দেখা হয়েছে বলে জানত চাইলাম, ওর কী সমস্যা?
ডাক্তার সাহেব জানালেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির কার্যক্ষমতা হারিয়েছে; ডায়ালাইসিস চলছে সপ্তাহে দুইবার করে। এই হসপিটালের একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন থাকলেও মাঝেমাঝেই আমার কাছে আসে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে পরামর্শ নিতে। তাছাড়া করোনা আক্রান্তের পর দীর্ঘমেয়াদী কিছু সমস্যা চলছে ওর। সেগুলোও আমি দেখছি। আমাদের এলাকায় তোমার মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল প্রকল্পের কথা শুনে ওকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল খুব। সেখানে খুব কম খরচে ডায়লাইসিস করা যাবে শুনে বললো যে ‘ততদিন আমি বাঁচবো তো চাচা?’ আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি যে ডায়লাইসিস করে মানুষ বহুদিন বাঁচতে পারে। ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উদাহরণও দিয়েছি। তা তোমার প্রজেক্টের অগ্রগতি কত দূর? বেশ কিছুদিন খোঁজখবর নিতে পারিনি নানান ব্যস্ততার কারণে।
উত্তর দিলাম, আসছে ঈদের পরদিন আপনাকে দিয়ে আউট ডোর উদ্বোধন করিয়ে চালু করে দিবো ভাবছি। ডাক্তার নিয়োগ চূড়ান্ত করে ফেলেছি আপনার পরামর্শকৃত তালিকা থেকে।
জানতে চাইলেন, ডাক্তারদের আবাসিক সুবিধার অবস্থা কি?
জানালাম বিদ্যুৎ, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, কেবল টিভি কানেকশন, পিএবিএক্স টেলিফোন লাইন এবং সাবস্টেশন আর জেনারেটর স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে একটি শীর্ষস্থানীয় মোবাইল অপারেটর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম। তারা একটি টাওয়ার স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। এসি লাগানোর কাজ চলছে এখন। আউট ডোরের জন্য অতি জরুরী কিছু মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট স্থানীয় ভাবেই কিনতে চাই। সেক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ অবশ্যই লাগবে। কবে সময় দিতে পারবেন জানালে আমার প্রোকিউরমেন্ট টিম পাঠিয়ে দিবো আপনার কাছে।
বিদায় নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে সুরভীর পাশের খালি সোফাটায় বসে বললাম, আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে শুনে খুব অবাক লাগছে! তুমিতো অপেক্ষা করার মতোন মেয়ে নও!
আহত কণ্ঠে বললো, আর যাইহোক জীবনের এই পর্যায়ে এসে তুমি অন্ততঃ কষ্ট দিও না আমাকে। তুমিতো কখনোই প্রতিশোধ পরায়ণ ছিলে না।
বললাম, এবার বলো, অপেক্ষা করছিলে কেন?
মলিন মুখে বললো, অনধিকার চর্চা করবো বলে।
বললাম, অধিকার চর্চা যে করেনি সে করবে অনধিকার চর্চা! অদ্ভুত না? তা কী চর্চা করতে চাও?
টলমলে চোখে বললো, চলো রুফটপ ক্যান্টিনে গিয়ে বসি। অনেক কথা বলবো তোমার সাথে।
বললাম, ক্যান্টিনে কেন? কথা বলার জন্য ক্যান্টিন খুব সুবিধাজনক হবে না। বরং আমার অফিসে চলো। অফিসের শতাধিক স্টাফের জন্য দুপুরের খাবার রান্না হয়। আমি সে রান্না থেকেই খাবার খাই। অফিসে গেলে নিরিবিলি কথাও বলা যাবে আর ক্যান্টিনের তুলনায় অনেকটাই ভেজালমুক্ত খাবারও খাওয়াতে পারবো তোমাকে।
এবার খুশিতে উজ্জ্বল মুখে বললো, তবে তাই হোক।
আপনার মতামত লিখুন :