হুসাইন আহমাদ খান: অকস্মাৎ কখনো ভেবে উঠি- চিন্তামগ্ন হই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে! কোথায় ছিলাম আমি এই কয়েকদিন আগেও? আমার কোনো অস্তিত্বই ছিল না এই ধরাতে। আমি চোখ মেলে দেখিনি এই পৃথিবী- অজ্ঞাত ছিলাম মায়াঘেরা এই জগতসংসার সম্পর্কে। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বলে উঠে, আমি ছিলাম- আমার অস্তিত্ব ছিল অজানা কোনো জগতে; যার কিছুই আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত নেই।
নিরন্তর জন্মপ্রক্রিয়ায় আজ আমি বৈচিতর্্েয ঠাঁসা এই পৃথিবীর বাসিন্দা। আমার সামনে- যতদূর চোখ যায়; হেঁটে চলার সক্ষমতা যতদূর; ইঞ্জিনচালিত গাড়ি, যান্ত্রিক ফড়িং আর পানির বুক চিরে এগিয়ে চলা জাহাজে করে পারি দেয়া যায় যত পথ- সমতল, কোথাও উঁচু-নিচু কিংবা বালুকাময় মরুভূমি আর দুই তৃতীয়াংশ পানি আর পানি- অথৈ সমুদ্র। উপরে খুঁটিবিহীন নীলিম আকাশ; যার আয়তন আজো অজানা। এখানেই নয় শেষ- এই পৃথিবীর বাইরেও আছে কতশত পৃথিবীÑ লাখ লাখ নক্ষত্র, আলোকময় চন্দ্র-সূর্য-তারা। আবার এরই মাঝে বাস করে কত লাখো-কোটি জীব ও জড়; যার গণনা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। এই যে বিশালতা, এই যে সংখ্যার সীমাহীনতা- যখন খুঁজি এর মাঝে আমার অস্তিত্ব, বিস্ময়ে নির্বাক হতে হয়; নিজের ক্ষুদ্রতায়, অপারগতায় ও অক্ষমতায়।
আমার জন্ম একটি পরিবারে, চলাফেরা একটি সমাজকে কেন্দ্র করে, বসবাস একটি রাষ্ট্রের অধীনে। আমি বেড়ে উঠি পরিবারের সদস্যদের মাঝে। যাদের সাথে সম্পর্ক রক্তের- একই খুন প্রবহমান আমাদের শিরা-উপশিরায়। লহুজড়িত এই বন্ধন অবিচ্ছিন্ন- চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। সমাজে আমার সরব পদচারণা। বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনদের সাথে উঠাবসা- ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার আদান-প্রদান। রাষ্ট্রীয় নীতির মাঝে আমার কার্যক্রম। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নীতিমালার গ-বহির্ভূত কোনো কথা ও কাজের অধিকার আমার নেই। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র ও তাদের বন্ধন-ভালোবাসা ও রীতিনীতি- আরো আছে সম্পদের মোহ, পদের লোভ ও নারীর প্রতি আকর্ষণ আমাকে এমন এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করায়, যার পর নিজের সৃষ্টি লক্ষ্যের দিকে তাকানোর ফুরসৎ মেলে না। দৃষ্টি পড়ে না আপন জীবনের ঊর্ধ্বজাগতিক উদ্দেশ্যের প্রতি।
কিন্তু যখন গভীর নিমগ্নতার সাথে, চিন্তার সরল রেখা অনুসরণ করে সামনে তাকাই- দেখি, আমার জীবনের সৃষ্টি লক্ষ্য আছে। সৃষ্টিজগতের অন্য সব কিছুর মতো আমার সৃষ্টিও নয় অনর্থক। আরো দেখি, আমি দাঁড়িয়ে আছি এক অনন্ত জীবনের দোরগোড়ায়। আমার জীবন-মৃত্যুর অমোঘ বিধানে বাঁধা। অলঙ্ঘনীয় নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। চলে আসতে পারে মৃত্যু, থেমে যেতে পারে বুকের উঠানামা- যেকোনো ক্ষণে, যেকোনো পরিস্থিতিতে। তখন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আমার কোনো গত্যন্তর থাকবে না। আমি রক্ষা পাবো না মৃত্যুর যন্ত্রণাকর ছোবল থেকে। এখানেই শেষ? না, বরং শুরু।
অন্তত জীবনের সূচনা এখান থেকেই- আমার আরেক জীবনের প্রারম্ভ। যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো ফুলের বাগিচা কিংবা আগুনের লেলিহান শিখা! জীবনের অনেকগুলো সালতামামি সম্পন্ন করেছি। হেলায়ফেলায় কাটিয়ে দিয়েছি অনেকগুলো দিবা-রাত্রী। সৃষ্টি লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পার করে দিয়েছি বহু কাল। এবার সময় হয়েছে সঠিক পথে ফিরে আসার। জীবনের যবনিকা নেমে আসার আগেই পরকালীন ‘পাথেয়’ গুছিয়ে নেয়ার।
এইচএবি/এসএ
আপনার মতামত লিখুন :