শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৫ জুলাই, ২০২২, ০৩:০৭ রাত
আপডেট : ১৫ জুলাই, ২০২২, ০৩:০৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হারমোনিয়ামের সেকাল-একাল

ছবি: সংগৃহীত

অনলাইন ডেস্ক: আজকের দিনে ভারতীয় সংগীতের অন্যতম অনুষঙ্গ হারমোনিয়াম। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রটির জন্মস্থান ইউরোপ। সেখান থেকে ভারতে এটি এসেছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো ভারতে আগমনের অব্যবহিত পরে হারমোনিয়াম জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। এমনকি এটিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও এ অঞ্চলেরর শিল্পী ও যন্ত্রীরা অনেকটা সময় নিয়েছিলেন।

হারমোনিয়াম প্রথম তৈরি করেন আলেকজান্ডার ডিবেইন। ১৮৪২ সালে তিনি নিজের নামে হারমোনিয়ামের পেটেন্ট নেন। হারমোনিয়াম ভারতে আসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে। বাদ্যযন্ত্রটি বাংলায় আসার পর রবীন্দ্রনাথ এটিকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছিলেন। তিনি এটিকে ‘ভারতীয় সংগীতের ক্ষতি’র কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমা সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অজ্ঞ ছিলেন না। তার নিজের সংগীত নির্মাণে পশ্চিমা ও ভারতীয় সংগীতের মিশ্রণ ঘটেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, আইরিশ, স্কটিশ মিউজিক দিয়ে প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটিকে পছন্দ করতে পারেননি। হারমোনিয়ামের প্রতি তার বিরাগ এতটাই ছিল যে এটিকে শান্তিনিকেতনে নিষিদ্ধ করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ একাই হারমোনিয়ামবিরোধী ছিলেন না। ১৯৪০ থেকে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওতে হারমোনিয়াম নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭১ সালে এটি পুনরায় ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। হারমোনিয়াম সম্পর্কে মূল যে অভিযোগটি ছিল তা হলো এটি ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল বাদ্যযন্ত্রগুলোর মতো সুললিত নয়। হারমোনিয়ামে কিছু ফিক্সড কি ইন্টারভাল রয়েছে। ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক মূলত মাইক্রোটোনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু হারমোনিয়ানের এ ফিক্সড কি ইন্টারভালের কারণে মাইক্রোটোনে সমস্যা হয়। বেশির ভাগ রবীন্দ্রসংগীতে মাইক্রোটোনের ব্যবহার রয়েছে। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ হারমোনিয়ামবিরোধী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।


হারমোনিয়াম মূলত ছোট আকারের কিবোর্ড। পরবর্তী সময়ে এটিতে একাধিক কিবোর্ড যুক্ত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের গির্জায় হারমোনিয়াম বাজাতে দেখা যেত। এখন সেখানে কিবোর্ড বাজানো হয়। নির্দিষ্ট করে বললে ১৯৩০ সাল নাগাদ ইউরোপে হারমোনিয়ামের জনপ্রিয়তা কমে আসে। ভারতে ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটেছিল। ১৮৭৫ সালে দ্বারিকা ঘোষের হাত ধরে ভারতীয় সংগীত আয়োজনে হারমোনিয়ামের অভিষেক হয়। এখানে হারমোনিয়ামের বেলো মূল যন্ত্রটির পেছন দিকে রাখা হয়। ইউরোপীয় হারমোনিয়ামে বেলোটি নিচের দিকে রাখা হতো। হাওয়া পাম্প করার ব্যবস্থাটি নিচের দিকে ছিল। পায়ের মাধ্যমে পাম্প করা হতো। ভারতে এসে এটিকে নতুন করে সাজানো হয় এবং ভারতীয় যন্ত্রীরা এক হাতে কিবোর্ডে সুর তোলার পাশাপাশি অন্য হাতে বিলোর মাধ্যমে পাম্পের কাজ করেন।

ইউরোপের সঙ্গে ভারতীয় ধারায় পার্থক্য থাকার আরেকটি কারণ হলো ইউরোপীয়রা দাঁড়িয়ে কিবোর্ড বাজাত, কিন্তু ভারতীয় সংগীতশিল্পী ও যন্ত্রীরা বসে গাওয়া ও বাজানোয় অভ্যস্ত ছিলেন। বিশেষত ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে এটি অনেকটা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু এ ব্যবস্থায়ও হারমোনিয়ামের চাবিগুলো (কি) স্থির থাকার কারণে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যালের সঙ্গে মিশ খেতে পারল না।

হারমোনিয়াম প্রথমে কলকাতায় এসেছিল, কিন্তু এরপর এটি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সংগীতকার ও যন্ত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে। তারা যন্ত্রটিকে ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে জুড়ে নিতে আরম্ভ করেন। এক্ষেত্রে গণপত রাও ও গোবিন্দ রাও তেম্বড়ে মারাঠি অপেরায় হারমোনিয়াম নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে ভারতীয় সংগীতে হারমোনিয়ামের আত্তীকরণ সহজ হয়। কিন্তু বাংলা ভাগের কারণে এটি আবার বাধাগ্রস্ত হয়। যেমন, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম এজেন্ডা ছিল ‘বিলেতি পণ্য বর্জন’। যেহেতু হারমোনিয়ামের পুরোটাই কিংবা কিছু অংশ ‘বিলেত’ থেকে আসে, তাই এটিকেও বয়কট করা হয়। হারমোনিয়াম বয়কটের পাশাপাশি সারেঙ্গিও পর্দার আড়ালে চলে যায়।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়, হারমোনিয়াম ভারতে হাজির হলেও স্থানীয় সংগীতের সঙ্গে মিলতে পারছিল না। ফলে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক-সংশ্লিষ্টরা মনে করতেন এতে তাদের চর্চার ক্ষতি হবে। এ কারণেই অল ইন্ডিয়া রেডিও ১৯৪০ সালে বাদ্যযন্ত্রটিকে নিষিদ্ধ করে। অন্যদিকে অনেক শিল্পী হারমোনিয়ামকে আপন করে নেন। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, বেগম আখতার প্রমুখ নিজেদের হারোমনিয়াম টিম বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এছাড়া হিন্দু ও শিখরা তাদের ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানে বাদ্যটি বাজানো শুরু করেন। এটি বাজানো সহজ এবং মানুষের ভিড়ের মধ্যে উচ্চ আওয়াজ তৈরি করতে সক্ষম বলে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। হারমোনিয়ামে সমস্যা থাকলেও এতে সুবিধা ছিল অনেক বেশি। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই ভারতীয় সংগীতে হারমোনিয়ামের ব্যবহার বাড়তে থাকে।

পরবর্তী সময়ে ভারতে সুফি ধারার সংগীতে হারমোনিয়ামের ব্যবহার বাড়ে। এমনকি সুফি গানের প্রধানতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে হারমোনিয়াম। পাকিস্তানেও হারমোনিয়ামের ব্যবহার বাড়তে থাকে। গজল থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্রটি বলিউডের গানেও ব্যবহূত হতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি এমন হয় যে মন্দির, গির্জা, গুরুদুয়ারা থেকে শুরু করে রেডিও, সিনেমায় হারমোনিয়াম প্রধান বাদ্যযন্ত্রের একটি হয়ে ওঠে। হারমোনিয়ামের আরেকটি সুবিধা হলো এটি সহজে বহনযোগ্য। নানা সময়ে এতে পরিবর্তন আনার চেষ্টাও করা হয়েছে। বিদ্যাধর ওকি নামে একজন চিকিৎসক-সংগীতশিল্পী হারমোনিয়ামে নব ব্যবহার করে সেমিটোন আনার চেষ্টা করেন। তার চেষ্টা সফল হয়। আগে যে মাইক্রোটোন হারমোনিয়ামে আনা যেত না সেটা আনা সম্ভব হয়। ফলে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে হারমোনিয়ামের সংযুক্তিতে আর কোনো বাধা থাকে না।

সব মিলিয়ে হারমোনিয়াম মূলত একটি ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র হলেও বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতের অন্যতম জরুরি বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখন কোনো ব্যক্তি সংগীত শিখতে গেলে তার শিক্ষা শুরু হয় হারমোনিয়াম দিয়ে। হারমোনিয়ামের এ জনপ্রিয়তা এবং ইউরোপীয় যন্ত্রটির ভারতে আত্তীকরণ ভারতের সংগীতের এগিয়ে যাওয়া সহজ করেছে বলে সংগীত বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন।

লেখা: আসরার আবেদিন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়