ইউরোপ মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইবেরীয় উপদ্বীপ ৫ লাখ ৮২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। বিশাল এই অঞ্চলে বর্তমানে স্পেন ও পর্তুগাল ছাড়াও রয়েছে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরা। ৭শ’ খ্রিস্টাব্দের দিকে মুসলিমরা এই ভূখণ্ডে পা রাখেন। মাত্র ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে অঞ্চলটির অত্যাচারী রাজা রডারিককে পরাজিত করে ইসলামের ঝাণ্ডা গাড়েন মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ।
পরবর্তীতে মাত্র এক দশকের মধ্যেই ইবেরীয় উপদ্বীপের অধিকাংশই মুসলিম শাসনের অধীনে চলে আসে। এরপর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলিম শাসকরাই স্পেন শাসন করেছিলেন। ইতিহাসে স্পেনে মুসলিম শাসনের এই যুগকে প্রায়ই জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ এই সময়ে গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও হাম্মামখানা (গোসলখানা) প্রতিষ্ঠা লাভ করার পাশাপাশি কবিতা, সাহিত্য এবং স্থাপত্যকলার মতো বিষয়গুলো বিকাশলাভ করেছিল।
এর আগে ক্যাথলিক কর্তৃক মুসলিম নির্যাতনের লোমহর্ষক ও বিভীষিকাময় ইতিহাস ছিল। ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, মুসলিম শাসনের আগে অসংখ্য মুসলিমকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো মুসলিম নাকি খৃষ্টান হয়ে মরতে চায়। জবাব মুসলিম হলেই বদলে যেতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতি। কেউ মুসলিম বললে সে সময় স্বাভাবিক ফাঁসি না দিয়ে তাকে চারদিক থেকে পাথর ছুড়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেয়া হতো।
কথিত আছে, একবার কয়েকজন আশ্রয়হীন বৃদ্ধ ছাড়াও নারী ও শিশুরা একটি বড় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় আশ্রিত ওইসব মানুষসহ পুরো মসজিদই বারুদের সাহায্যে উড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া এক ইতিহাসবিদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ওই সময়ে সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ছিল। একবার তিনি নিজে একজন মুসলিম নারীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন, যার চারপাশে ওই নারীর ছয় সন্তানের মৃতদেহও পড়ে ছিল। ওই সময় একটি জীবিত দুগ্ধপোষ্য শিশু মায়ের দুধের বদলে রক্ত পান করছিল। অথচ, লোভী সৈন্যরা মরদেহগুলো থেকে গহনা খুলে নিতে ব্যস্ত ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন বর্ণনায় বহু মুসলিমদের একটি জাহাজে তুলে সেটি মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়ার কথাও এসেছে।
তবে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমরা স্পেনে পা রাখার পর মাত্র এক দশকের মধ্যেই তারা ইবেরীয় উপদ্বীপের অধিকাংশই নিজেদের শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। এর মধ্যদিয়ে ক্যাথলিক নির্যাতনের অবসানের পাশাপাশি বিকাশ লাভ করতে থাকে সাহিত্য ও স্থাপত্যকলার মতো বিষয়গুলো। যার ফলশ্রুতিতে খ্রিস্টীয় নবম শতকে আন্দালুস (মুসলিম শাসিত অঞ্চল) ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর অঞ্চল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে এই ভূখণ্ডের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। আর এর রাজধানী কর্ডোভা মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে প্রায় সাড়ে ৭০০ বছর পর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিভেদ আর জুলুম-নির্যাতনে এই স্পেনেই খ্রিস্টানদের কাছে পরাজিত হয় মুসলিমরা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিমরা স্পেন বিজয়ের পর প্রথম দিকে মহানবী (সা.) ও তাঁর খলিফাদের নীতি অনুসরণ করলেও পরবর্তীতে তারা এটি থেকে অনেকাংশেই সরে যায়। যার ফলে শাসকরা নিজেদের মনগড়া মতবাদে দেশ চালাতেন। সেই সঙ্গে প্রজাদের অধিকারবঞ্চিত করে নিজেরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। এমনকি অনেক শাসক মুসলিম হয়েও আলেম-ওলামাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিলেন।
১০৩১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া শাসনের (উমাইয়া রাজবংশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্য) পতন হলে মুসলিম শাসিত অঞ্চল আন্দালুস অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। সে সময় এই রাজ্যগুলো তাইফা নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে রাজ্যগুলো দুর্বল ও একতাবদ্ধ না থাকায় ধীরে ধীরে উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। এরপর পরবর্তী ২০০ বছরের মধ্যে খ্রিস্টান আগ্রাসনে এই রাজ্যগুলোর একে একে পতন ঘটতে থাকে। এমনকি ১২৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণের একমাত্র গ্রানাডা (আন্দালুসের গ্রানাডা প্রদেশের রাজধানী) ছাড়া বাকি সব রাজ্য মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে গ্রানাডার শাসকেরা উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্টাইলের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। ১২৩৬ সালে কর্ভোভার পতনের পর হওয়া ওই চুক্তি অনুযায়ী, বার্ষিক কর দেয়ার শর্তে গ্রানাডা নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ, স্বাধীনভাবে গ্রানাডা নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে চাইলে তাদের খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যকে কর বাধ্যতামূলক কর দিতে হবে।
গ্রানাডা মুসলিমদের হাতছাড়া না হওয়ার বড় একটি কারণ ছিল এর ভৌগোলিক অবস্থান। রাজ্যটি ছিল দক্ষিণ স্পেনের সিয়েরা নেভদার পাহাড়ি অঞ্চলে। এ কারণে সামরিক দিক থেকে ক্যাস্টাইলের থেকে দুর্বল হলেও গ্রানাডার প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছিল সিয়েরা নেভদার পাহাড়। তবে পরবর্তীতে কার্ভোভার পতনের পর হওয়া চুক্তির মাধ্যমে গ্রানাডার শাসকরা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার বদলে উল্টো শত্রুদের হাতকেই বেশি শক্তিশালী করে। যদিও ২৫০ বছরের বেশি সময় গ্রানাডা খ্রিস্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যের করদ রাজ্য হিসেবে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই সময়েও এর চারপাশের বৈরী খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর অবস্থানে সবসময় গ্রানাডা স্বাধীনতা হারানোর আশঙ্কায় ছিল।
পরবর্তীতে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আরাগনের রাজা ফারডিন্যান্ড ক্যাস্টাইলের রানী ইসাবেলাকে বিয়ে করেন। এর মধ্যদিয়ে ইবেরীয় উপদ্বীপের দুইটি শক্তিশালী খ্রিস্টান রাজ্য একত্রিত হয়। পরে এই ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তি আন্দালুসের ভূখণ্ড থেকে সর্বশেষ মুসলিম রাজ্যটির স্বাধীন শাসনের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একপর্যায়ে ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডার সঙ্গে এই ঐক্যবদ্ধ খ্রিস্টান শক্তির সংঘর্ষ শুরু হয়। সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও গ্রানাডার অধিবাসীরা অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। আন্দালুসের সর্বশেষ অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মুসলিমরা ছাড়াও সৈন্যবাহিনী চরম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করলেও শাসকেরা তেমন সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে স্পেনে মুসলিম শাসনের দীর্ঘ অধ্যায়ের ইতি ঘটে। উৎস: চ্যানেল২৪
আপনার মতামত লিখুন :