ফয়সাল চৌধুরী,কুষ্টিয়া : আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়, তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে….।
বিরহের সুরে ভাঙলো কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে বাউল সাধুদের মিলনমেলা ‘সাধুর হাট’। সাধক ফকির লালন সাঁইজির ১৩৪ তম তিরোধান দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ির সাঁইজির ধামে
দেশ-বিদেশের কয়েক লক্ষ লালন ভক্ত-অনুসারীর ও দর্শনার্থীদের মিলন ঘটে ।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) সাধুর হাট ভেঙে গেছে। পূর্ণ সেবার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সাধু সঙ্গের আনুষ্ঠানিকতা। শুক্রবার শেষ হয়েছে সাধুসঙ্গ। সামনের দৌলপূর্ণিমায় মিলনের আকাঙ্খা নিয়ে লালনের আখড়া ছেড়েছেন বাউল সাধুরা। এর আগে ১৭ অক্টেম্বর সন্ধ্যায় তিরোধান দিবসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মিজ ফরিদা আখতার।
সাধুদের মিলনমেলাকে ঘিরে একাডেমির পাশে কালি নদীর ধারে গ্রাম্য মেলা চলছে বেশ জোরেশোরে। এবারে লালন উৎসবে মানুষের উপস্থিতি এত বেশি ছিল যে অতীতে সব রেকর্ড ভেঙে গেছে।
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে, ফকির লালন কয় জাতের কিরূপ দেখলামনা এ সংসারে...ডুবলে পারে রতনপাবি, বাউল সাঁইজির এসব আধ্যাত্মিক গানের সুরে গত তিন দিন মজে ছিল ছেউড়িয়া আখড়াবাড়ি।
এদিকে বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু সকালের অধিবাসে পায়েস ও মুড়ির বাল্যসেবা গ্রহণ করেন। দুপুরে তারা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আখতারের উপস্থিত থেকে পুণ্যসেবার আনুষ্ঠিকতার উদ্বোধন করেন। পুণ্যসেবার মধ্যে ছিল ভাত, মাছ, তিন পদের সবজি তরকারি ও দধি।
বাউল ভক্তরা জানান, হৃদয়ের টানে প্রতি বছর এখানে ছুটে আসেন তারা। লালনের অহিংসার বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পপারলেই কেবল সব আয়োজন সার্থক হবে বলে মনে করেন তারা।
লালন একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্য দিয়ে তিরোধান দিবসের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। দিনকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কার্যকরণ। গুরু-শিষ্যের ভাব আদান প্রদান, লালন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা আর সেইসঙ্গে নিজস্ব ঘরনায় বসে চলে লালনের গান পরিবেশন। ‘তুমি গোষ্ঠে চলো হরি মুরার’, ‘আর আমারে মারিসনে মা’ এসব গান পরিবেশন করা হয়। এরপর ‘বাল্যসেবা’। পর্বে সকালে ‘ভোগগ্রহণ’ করেন অনেকে। তারপর পায়েস-মুড়ি খেতে দেয়া হয়। ভোগগ্রহণের পালা শেষে গানবাজনা, তত্ত্ব-আলোচনা চলতে থাকে। বুধবার দুপুরে হয় ‘পূর্ণসেবা’। একাডেমি কর্তৃপক্ষই এসবের আয়োজন করেছেন।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বাউলভক্তরা আরও জানান, সাঁইয়ের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তার ভক্ত আর শিষ্যদের নিয়ে আড়াই দিনের উৎসব করতেন। সেই নিয়ম মেনেই বাউলরা ভাটায় আসেন, উজানে ফিরে যান যে যার আপন নিবাসে। প্রকৃত বাউলরা সরকারি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখেন না। তাদের মঞ্চে ডাকলেও তারা আসন ছেড়ে উঠেন না। লালন আখড়ার আশপাশে ও একাডেমির নিচে যারা আসন গাড়েন তারা সাঁইকে ভক্তি আর আরাধনায় নিমগ্ন থাকেন। কখনো স্থান ত্যাগ করেন না।
ভাববাদী লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধন সংগীত স্রষ্টা বাউল সম্রাট লালন ফকির। চৈত্রের এক দোলপুর্নিমার দিনে দুরারোগ্য এক ব্যাধি নিয়ে লালন সাঁইজির আবির্ভাব ঘটেছিলো ছেউড়িয়ার কালী নদীর ঘাটে। এর পর থেকে সাঁইজি তার জীবদ্দশায় সাধুসঙ্গ করতেন। ১২৯৭ (১৮৯০ সাল) বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক উপমহাদেশে ভাবুক ও প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই জেলার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।
সাঁইজির দেহত্যাগের পর তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এবং মরমিবানীকে প্রচার করার জন্য তার অনুসারিরা এই দিনটিতে তাকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করে আসতেছে। বছরে দুটি উৎসব হয়ে থাকে। একটি হয়ে থাকে দোল পূর্ণিমায়, আরেকটি কার্তিক মাসে। প্রতিবছর ১ কার্তিক আড়ম্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস পালন করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :