আনোয়ার হক: সাধারণতঃ শীত মৌসুমের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে গেরস্তের ক্ষেতের ধান কেটে মাড়িয়ে গোলায় উঠানো শেষ হলে গ্রামবাসীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো সারা গ্রামের মানুষ একসাথে বসে একবেলা কলাপাতায় মেন্দা ভাত খাওয়ার আয়োজন। আয়োজনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পনেরো দিনব্যাপী চলতো কর্মযজ্ঞ! প্রথম উঠান বৈঠকে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হতো। দ্বিতীয় বৈঠকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল কর্তৃক সংগৃহিত লোকসংখ্যার ভিত্তিতে ব্যয় প্রাক্কলন করে গ্রামবাসীর পারিবারিক সচ্ছলতা বিচার বিশ্লেষণ করে মাথাপিছু চাঁদা নির্ধারণ করে স্বেচ্ছাসেবকদের অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হতো। তুলনামূলক বিত্তবান গ্রামবাসীরা প্রাক্কলিত ব্যয়ের ঘাটতি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করতেন।
পরবর্তী বৈঠকে নির্ধারণ করা হতো দিনক্ষণ। সাধারণতঃ নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন গরু ও চাল সহ সকল প্রয়োজনীয় উপাদান কেনা সম্পন্ন করা হতো।
বিয়ে, আকিকা, খাতনা, দোয়ার মাহফিল কিম্বা সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠানও যেন অপূর্ণ থেকে যেতো ঐতিহ্যবাহী 'মেন্দা' ছাড়া।
'মেন্দা' নামটি অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে অপরিচিত মনে হলেও উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ এবং টাঙ্গাইলের বেশ কিছু এলাকা বিশেষ করে সমগ্র জামালপুরবাসীর কাছে এ যেন এক অমৃতসম খাবার। শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটিকে কেউ মেন্দা এবং কেউ কেউ মিল্লি/পিঠালি/পিটুলি নামে চেনেন। নামে যাই হোক না কেন, এর স্বাদ যে একবার পায় তার কাছে এটা বিশেষ এক সুস্বাদু খাবার হিসাবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। ঐতিহ্য বিবেচনায় এটিকে চট্টগ্রামের মেজবানির সাথে তুলনা করতে চান অনেকেই।
ধারণা করা হয় বিশেষ প্রক্রিয়ার রন্ধনপ্রণালীই খাবারটিকে ভিন্নমাত্রার বিশেষত্ব এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মেন্দা বিশেষজ্ঞ এক বাবুর্চি বলেন, ''প্রথমে হাঁড়িতে সরিষার তেল দিতে হবে। বলে রাখা ভালো, সরিষার তেল ছাড়া কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ম্যান্দার আসল স্বাদ আসবে না। মাংস ভালোভাবে কষানো হয়ে গেলে ঝোল দেয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর অল্প অল্প করে চালের গুঁড়া মেশাতে হয়। বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হয় চালের গুঁড়া যেন কোনোভাবেই দলা বেঁধে না যায়। তাই চালের গুঁড়া মেশানোর সময় অনবরত নাড়তে হয়। মূলতঃ দক্ষ হাতে মিশানো চালের গুঁড়ার সঠিক ঘনত্বই এই খাবারের স্বাদের অন্যতম কারণ।
স্বাভাবিক ঝালের তুলনায় মেন্দাতে একটু বেশি করেই ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। গরুর মাংস ছাড়াও মহিষের মাংস ব্যবহার করা যায় মেন্দা রান্নায়।
আগের দিনে কলাপাতায় ভাতের সাথে মেন্দা খেতে দেওয়া হতো, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর কলাপাতার ব্যবহার তেমন একটা হয় না। কলার পাতার স্বল্পতা আর প্রত্যন্ত গ্রামেও ডেকোরেটর সার্ভিস সহজলভ্য হওয়ায় বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে আধুনিক থালা প্লেটই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে বসবাসকারী ঐতিহ্য প্রিয় অনেক জামালপুরী পরিবারে ঘরোয়াভাবে মেন্দা রান্না করা, খাওয়া এবং খাওয়ানোর প্রচলন আছে। ইউটিউবের কল্যাণে ইদানীং এর ব্যপকতা বেড়ে চলছে বলে ধারণা করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :