শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রাত মুসলিম সমাজে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। বিশেষত উপমহাদেশীয় মুসলিম সংস্কৃতিতে এই রাতকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকের বিশ্বাস, এটি গুনাহ মাফের, ভাগ্য নির্ধারণের এবং বিশেষ ইবাদতের রাত। তবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে এই ধারণাগুলোর বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
শরিয়তের মূল উৎস থেকে শবেবরাতের প্রকৃত অবস্থান অনুধাবন করা জরুরি, যাতে সমাজে প্রচলিত বিদআত ও ভুল বিশ্বাস থেকে মুক্ত থাকা যায়।
শাবান মাস রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি নফল রোজা রাখতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৭০)
এ ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০; তিরমিজি, হাদিস : ৭৩৯)
এটি নির্দেশ করে যে এটি আল্লাহর রহমতের রাত। তবে এই রাতে নির্দিষ্ট কোনো নামাজ, দোয়া বা বিশেষ ইবাদতের নির্দেশ রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে পাওয়া যায় না।
অনেকেই মনে করেন, শবেবরাতে মানুষের পরবর্তী বছরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে সুরা দুখানের আয়াত উল্লেখ করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই আমরা এক মহিমান্বিত রাতে কোরআন অবতীর্ণ করেছি। এতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ৩-৪)
তবে বেশির ভাগ তাফসিরবিদ একমত যে এখানে ‘মহিমান্বিত রাত’ বলতে লাইলাতুল কদরকে বোঝানো হয়েছে, শবেবরাতকে নয়। (তাফসির ইবনে কাসির, দুখান : ৩-৪)
কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, ভাগ্য নির্ধারণের রাত হলো লাইলাতুল কদর। (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৫)
তাই শবেবরাতকে ভাগ্য নির্ধারণের রাত হিসেবে গণ্য করা একটি ভুল ধারণা।
কিছু দুর্বল ও জাল হাদিসের ভিত্তিতে শবেবরাতে নির্দিষ্ট নামাজ, বিশেষ দোয়া বা সম্মিলিত ইবাদতের প্রচলন হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ—মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকাত সালাত আদায়ের কথা বলা হয়, যা বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। (ইমাম ইবনে জাওজি, আল-মাওদুআত, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১২৭)
একইভাবে ছয় রাকাত নামাজ পড়ে নির্দিষ্ট দোয়া পাঠের কথাও কোনো বিশুদ্ধ সূত্রে পাওয়া যায় না।
এ রাতে করণীয় হলো, একান্তভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা। একাকী ইবাদত করা জায়েজ, তবে সম্মিলিতভাবে বিশেষ কোনো আমল প্রমাণিত নয়। একাকী কেউ চাইলে অতিরিক্ত নামাজ, দোয়া বা কোনো বিশেষ আয়াত পাঠ করতে পারে। যেহেতু শাবান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বেশি নফল রোজা রাখতেন, তাই কেউ চাইলে ১৫ শাবানেও রোজা রাখা যায়, আবার দিনটি আইয়ামে বিজের (আরবি মাসের ১৩, ১৪, ১৫) অন্তর্ভুক্ত। এই দিনগুলোতে প্রতি মাসে নবী করিম (সা.) রোজা রাখতেন।
শবেবরাতের অন্যতম শিক্ষা হলো হিংসা, বিদ্বেষ ও শিরক থেকে মুক্ত থাকা। হাদিসে এসেছে, আল্লাহ এ রাতে মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের ক্ষমা করেন না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৯০)
ইসলামে শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ, যা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৮)
শিরকের মধ্যে পড়ে গণকের কাছে যাওয়া (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩০), মৃত ব্যক্তিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং বিধান প্রণয়নে আল্লাহর পরিবর্তে মানুষকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী মনে করা শিরক। এগুলো থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হিংসা ও বিদ্বেষ মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে গ্রাস করে, যেমন আগুন কাঠকে পুড়িয়ে ফেলে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৩)
একজন মুসলমানের উচিত হিংসা ও বিদ্বেষ পরিহার করা এবং অন্যের কল্যাণ কামনা করা। এ রাতে সত্যিকারের কল্যাণ লাভ করতে চাইলে মানুষকে ক্ষমা করা, নিজের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে শুদ্ধ জীবনযাপনের সংকল্প করা আবশ্যক।
শবেবরাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইখলাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)
এই রাতে আল্লাহর দয়া লাভের জন্য অন্তর থেকে খাঁটি মনে তাওবা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়াবি লোভ, অহংকার ও কপটতা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের আনুগত্য প্রকাশ করা উচিত।
শবেবরাতের প্রকৃত শিক্ষা হলো আত্মবিশ্লেষণ, আল্লাহর রহমতের আশা এবং শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকা। এ রাতে কেবল কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী ইবাদত করা উচিত এবং সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও বিদআত পরিহার করা জরুরি। আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা লাভের জন্য অন্তর থেকে খাঁটি মনে তাওবা করাই এ রাতের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
লেখক : মো. যোবায়েরুল ইসলাম, প্রভাষক, সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদরাসা। সূত্র : বিডিপ্রতিদিন
আপনার মতামত লিখুন :