ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, খাজা নাসির উদ্দিন তুসি মারাগেহ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে এবং তার নিজ হাতে গড়া ছাত্রদের দিয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিকাশের মাধ্যমে মঙ্গোলদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইরানে প্রবেশের পর মঙ্গোলদের বিকাশ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনা যার মাধ্যমে এটি প্রতিয়মান হয় যে এই জাতির ওপর ইরানিদের সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রভাব রয়েছে। এই রূপান্তরটি ঘটেছিল প্রধানত বিশিষ্ট ইরানি ব্যক্তিত্ব এবং মনিষী খাজা নাসির উদ্দিন তুসি'র (১২০১-১২৭৪ খ্রিস্টাব্দ) সময়ে যিনি মঙ্গোলদের আচরণ এবং চিন্তাধারায় ভারসাম্য ও সংযম সৃষ্টিতে গূরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। পার্সটুডের রিপোর্ট অনুসারে আজকের নিবন্ধে ইরানি মনিষী খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির মাধ্যমে মঙ্গোলদের শিক্ষা এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের ৬টি পর্যায় আলোকপাত করা হয়েছে।
১. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতির চিন্তাধারার সাথে মঙ্গোলদের পরিচিত করা
খাজা নাসির উদ্দিন তুসি তৎকালিন মোঙ্গল বাদশাহ হালাকু খানের দরবারে প্রবেশ করে বিজ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন বিজ্ঞান-ভিত্তিক বই রচনা করে এবং এই সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বই অনুবাদ করে তিনি মোঙ্গলদের একটি অংশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ইরানী সভ্যতার গবেষক হোসেন মাসুমি হামদানি'র মতে, 'যে সময়কালে আলামুত দুর্গের পরিস্থিতি অত্যন্ত সংঘাতপূর্ণ ছিল, খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি ইসমাইলীদের মধ্যে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং এই সুযোগে তিনি তার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন এবং বিজ্ঞান ও গণিতের নানা ক্ষেত্রে বই লিখতে সক্ষম হন।' খাজা নাসির উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে করা অনুবাদগুলো মঙ্গোলদেরকে অন্যান্য জাতির সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করে তোলে। খাজা নাসিরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ৬৫৭ হিজরিতে মারাগেহ পর্যবক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। মঙ্গোল হালাকু খানের সমর্থনে এই মানমন্দিরটি তার সময়ের একটি বড় বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এই পরিস্থিতি ব্যবহার করে খাজা নাসির উদ্দিন সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানীকে একত্রিত করেন এবং নতুন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করেন যা মঙ্গোলদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটায় এবং বিশ্ব সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে ভূমিকা পালন করে।
২. সংযমের পথ অনুসরণ করা
খাজা নাসিরের চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করা এবং তাদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সুখ নির্ভর করে চরম ও বাড়াবাড়ির মধ্যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে। তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কিছু মঙ্গোল যেমন হালাকু খান যিনি খাজা নাসির উদ্দিনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলেন চরম সহিংসতা এবং নিষ্ঠুরতা থেকে সরে এসেছিলেন এবং একটি মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকারি দায়িত্ব পালনে মনোনিবেশ করেন।
৩. ইরানি যুক্তিবাদিতা এবং মনোভাবের সাথে পরিচিতি হওয়া
খাজা নাসির ইবনে সিনার দার্শনিক কাজগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রচার করে মঙ্গোলদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইতিহাস গবেষক হাসান আনসারী'এর মতে,খাজা নাসির রেফারেন্সের বর্ণনা লিখে ইবনে সিনার দর্শনের প্রাচীন ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে শুরু করেন।" এর ফলে মঙ্গোলরা ভিন্ন জাতির বিশ্বদৃষ্টি শিখতে পেরেছিল এবং এর ফলে তারা চরম সহিংসতার পথ পরিহার করে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে মনোনিবেশ করেন।
৪. মারাগেহ স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং মঙ্গোল শিশুদের শিক্ষা
মারাগেহ স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্রদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে খাজা নাসির উদ্দিন তূসি মঙ্গোলদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা প্রসারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই স্কুলটি শুধুমাত্র শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি, বরং এটাও দেখিয়েছে যে মঙ্গোলরা ইরানি সংস্কৃতি ও জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়ে চিন্তা ও শিল্পের কারিগরও হতে পারে।
৫. মঙ্গোলদের জীবনধারা পরিবর্তনের লক্ষ্যে ইরানি পরিচয় সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা
খাজা নাসির একটি জাতীয় প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মঙ্গোলদের বিপরীতে ইরানি জাতির পরিচয় সংরক্ষণ করার পাশাপাশি তা শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। ইরানি-ইসলামি সংস্কৃতিকে সত্যায়নের মাধ্যমে এবং মঙ্গোলদের মনে এর বিভিন্ন মাত্রা ও জীবনমুখী শিক্ষা ছড়িয়ে দিয়ে তিনি মঙ্গোলদের প্রভাবিত করতে এবং তাদের জীবনধারায় গভীর পরিবর্তন ঘটাতে সফল হন। আনসারী এ প্রসঙ্গে বলেন: "আমি মনে করি খাজা নাসির বছরের পর বছর ধরে এই বিষয়গুলোকে তার মনের মধ্যে চর্চা করেছিলেন।"
৬. নৈতিক নীতির নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের প্রচার
এগুলোর পাশাপাশি খাজা নাসির নীতিশাস্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা ভুলে যাননি এবং নাসেরী নীতিশাস্ত্র রচনা করে তিনি নৈতিক ও রাজনৈতিক ধারণাগুলোকে এমনভাবে একত্রিত করেছিলেন যেগুলো পরবর্তীতে মঙ্গোলদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই বইটিতে খাজা নাসির বুদ্ধিবৃত্তিক সংযম এবং রাজনীতির সাথে নীতিশাস্ত্রকে সংযুক্ত করার প্রয়াস হিসেবে দেখিয়েছেন। এই ক্ষেত্রের একজন গবেষক হিসেবে জাওয়াদ আনসারি বলেছেন, 'আখলাক নাসেরি ফার্সি ভাষায় একটি দার্শনিক বই এবং এই বইতে খাজা নৈতিকতাকে ধর্ম ও রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন।'
পরিশেষে,সংক্ষিপ্তভাবে বলা এই বিষয়গুলো দেখায় কীভাবে ইরানিদের মাধ্যমে বিশেষ করে খাজা নাসির উদ্দিন তুসির মাধ্যমে মঙ্গোলদের মনোভাব পরিবর্তনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। পাশাপাশি তাদেরকে বর্বর ও নিষ্ঠুর মানুষ থেকে সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক চর্চার প্রতি মনোনিবেশ করেছিল এবং তাদেরকে প্রকৃত রাজনীতিবিদে পরিণত করেছিল। এই পরিস্থিতি মঙ্গোলদেরকে কেবল রাজনীতি ও নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যের দিকে পরিচালিত করেনি,বরং ইরানি-ইসলামিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ও সীমাহীন আত্ম পরিচয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :