পার্স-টুডে- প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক অধ্যাপক গোলাম হোসেইন দিইনানি বলেছেন, বর্তমানে মানবজাতির সংকট হল এটা যে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছাগুলোর পেছনে ছুটছে এবং আকল্ বা বুদ্ধিবৃত্তি তথা জ্ঞানকে ধামাচাপা দিচ্ছে।
বার্তা সংস্থা ইকনা জানিয়েছে, প্রজ্ঞা ও দর্শন দিবস উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক গোলাম হোসেইন দিইনানি বুদ্ধিবৃত্তি বা আক্লের শ্রেষ্ঠত্ব, ইচ্ছা ও জানা বা জ্ঞানের মধ্যে দ্বন্দ্ব, আকল্-নির্ভর জীবন, কুরআনে প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও প্রজ্ঞা, অধিকতর উপলব্ধি ও অনুধাবনের জন্য প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞা বোঝানোর ক্ষেত্রে ফার্সি ভাষার সহায়তা বা অবদানসহ আরও অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন।
পবিত্র কুরআনের মধ্যে প্রজ্ঞা বা হিকমত থাকা সম্পর্কে সুরা হুদ-এর প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে: এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াত সমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত বা প্রজ্ঞাপূর্ণ অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক প্রজ্ঞাময় বা মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে নাজিল হয়েছে।– পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতের মত এ আয়াতেও আকল্-এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কুরআনের সমস্ত বাক্য বা বাণী আকল্ বা বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অধ্যাপক গোলাম হোসেইন দিইনানির মতে আকল্-এর চেয়ে সুদৃঢ় ও উচ্চতর বিশ্বে আর কিছুই নেই। তাঁর মতে, বর্তমানে মানবজাতির সংকট হল এটা যে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছাগুলোর পেছনে ছুটছে এবং জ্ঞানকে ধামাচাপা দিচ্ছে। আমাদের জানা ও চাওয়ার মধ্যে সব সময়ই দ্বন্দ্ব ঘটছে। আমরা আমাদের জানা বিষয় বা জ্ঞানকে প্রাধান্য না দিয়ে ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। আর মানুষ ভুল করছে এখানেই।
ধর্মীয় সাহিত্যে নৈতিকতা ও প্রজ্ঞা পাশাপাশি উচ্চারিত। হাকিম বা প্রজ্ঞাবান তাকে বলা হয় যে খোদায়ি বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলীতে বিশ্বাসী। আর এ বিষয়টিও আকল্ বা প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। হাকিমের মধ্যে প্রজ্ঞা বা হিকমাত আছে বলেই তিনি বুঝতে পারেন, অর্থাৎ খোদা ও খোদার গুণাবলী তিনি বুঝতে পারেন।
একজন দার্শনিক কি হাকিম বা প্রজ্ঞাবান নাও হতে পারেন? –এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক গোলাম হোসেইন দিইনানি বলেছেন, না, তা হতে পারে না। ফিলসুফ বা ফিলোসফার তথা দার্শনিক একটি গ্রিক শব্দ, আর হাকিম হচ্ছে ইসলামী পরিভাষা। দুটোই সমান বা অভিন্ন। প্রজ্ঞা বা হিকমাত জানা বেশ কঠিন। ফিলো ও সফার – গ্রিক এ কথাটির অর্থ যে প্রজ্ঞা বা জ্ঞানকে ভালবাসে। আমাদের উচিত প্রজ্ঞার অনুরাগী হওয়া। অন্য কথায় অনুধাবনের অনুরাগী হওয়া উচিত আমাদের। ইবাদাতেও অনুধাবনকে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং তাতে (আল্লাহর) নৈকট্য পাওয়া যায়।
নৈকট্য বলতে কি বোঝায়? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, উপলব্ধির নৈকট্য, অজ্ঞতার মাধ্যমে কোনো কিছুর কাছে যাওয়া যায় না।
জানার ইচ্ছা ও বোঝার ইচ্ছা অর্জনের জন্য কি করা উচিত?
এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক গোলাম হোসেইন দিইনানি বলেছেন আমাদেরকে অবশ্যই এ জন্য প্রবৃত্তির খেয়ালিপনা ও বেপরোয়া বা উদ্ধত ইচ্ছাগুলোর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে কোন্ কোন্ বিষয়গুলো যৌক্তিক ও বিবেক-বুদ্ধির দাবিগুলো কি কি? যদি আমাদের বুদ্ধি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কাজকর্ম করতে হবে। সবাই বুদ্ধি-বিবেক খাটায় না। তাই এদের উদ্দেশে মহান আল্লাহ বলেছেন, শরিয়ত বা ইসলামী বিধান মেনে চল।
নতুন প্রজন্মের মানুষের অনেকেই অগোছালো চিন্তা-ভাবনার শিকার ও বুদ্ধিমত্তাকে নির্বাসনে দিয়ে রেখেছে নিজের নানা প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে। এ অবস্থার প্রতিকার কি? জনাব দিইনানি এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আকল্ ভুল করে না, কিন্তু ইচ্ছাগুলো আকল-এর ওপর বিজয়ী হয়। মানুষের যেমন আকল্ বা বিবেক আছে তেমনি আছে মানবীয় কুপ্রবৃত্তি যেমন, অর্থের লোভ, পদের আকর্ষণ ও এমন হাজারো বিপদ বা বিপর্যয় ইত্যাদি। এসবই হল নফসানিয়াত বা কুপ্রবৃত্তি। এসবকে যদি আকল-এর ওপর প্রাধান্য দেয়া না হয় ও না বুঝেও শরিয়ত মেনে চলে তাহলে শরিয়ত তাকে পথ দেখাবে।
শরিয়ত এক্ষেত্রে আসলে কি বলে? উত্তরে তিনি বলেছেন, শরিয়ত চলমান সঠিক বিষয়গুলো আমাদের দেখিয়ে দেয়। শরিয়ত বলে নামাজ পড়, রোজা রাখ, চুরি করো না, খারাপ কাজ করো না ইত্যাদি।
শরিয়ত মানব-জীবনের আলোকিত পথ দেখায়, তো হিকমাতের প্রতি গুরুত্ব মানুষের জন্য কি বার্তা দেয়? হিকমত হল এটাই যে তুমি যেহেতু সব কিছুর বাস্তবতা বা রহস্য বোঝ না তাই তোমাকে শরিয়ত মেনে চলতে হবে, অর্থাৎ আল্লাহ মহানবী (সা)'র মাধ্যমে বাস্তবতা বা সত্যগুলো আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
প্রথম মুসলিম দার্শনিক ফারাবি। হিকমাত ও দর্শন দিবসে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। সেরা ইরানি দার্শনিক বা হাকিমদের দর্শন সরাসরি জানার বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?
জনাব দিইনানি এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ফারাবি ও ইবনে সিনার দর্শন নজিরবিহীন। আজকাল দর্শনের নামে কিছু অর্থহীন কথা বলা হয়। ফারাবি ও ইবনে সিনার বক্তব্যগুলো অত্যন্ত উচ্চ মানের। এসব পড়তে হবে বড় ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষকদের কাছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে উনাদের কথা বোঝা যাবে না।
আধুনিক যুগে মানুষ নতুন কি কি জ্ঞান যুক্ত করেছে? জনাব দিইনানি এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তারা কিছু অর্থহীন জ্ঞান তৈরি করেছে! অর্থাৎ প্রভাবহীন কিছু তথ্য। তথ্য ও জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। সারাদিন আমরা নানা মিডিয়া থেকে অনেক তথ্য পাচ্ছি যা মানুষের মনকে ছেয়ে রাখে, কিন্তু এসব তথ্য তাদের গভীরতা কমিয়ে দেয়। এসব মানুষকে সমৃদ্ধ ও জ্ঞানগর্ভ করে না। অতীতের দার্শনিকরা গভীরভাবে ভাবতেন ও ভাবার সময় পেতেন এবং জ্ঞানের গভীরে পৌঁছতেন। আজকাল অপ্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য আমরা পাচ্ছি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন মানুষের কাছে এই আপদ এনে দিয়েছে।
তাহলে আধুনিক এ বিশ্বে কি করা উচিত? জনাব দিইনানি এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আমি এটা বলতে পারি না যে অবশ্যই কি কি করা উচিত। আমার পরামর্শ হল এটা যে আমরা যেন প্রাত্যহিক নানা গতানুগতিকতার শিকার না হই। আমাদের উচিত গভীর দর্শনের বইগুলো পড়া। আমি ইসলামী দর্শনের বিষয়ে একটি কোর্স বা সিরিজ লেখা লিখেছি তা পড়ুন। ইসলামী বিশ্বের দার্শনিক চিন্তাগুলো যথাযথভাবে পড়ুন। সমস্যার সম্মুখীন হলে প্রশ্ন করুন। আধুনিক যুগে টেকনিক ও শিল্পের অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু চিন্তার অগ্রগতি হয়নি। তথ্য বেড়েছে কিন্তু প্রশান্তি কমেছে।
ফার্সি সাহিত্য দর্শন বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক। বিশেষ করে হাফিজ ও সাদির কবিতা ভালো করে বুঝে শুনে পড়তে পারলে অনেক কিছু জানা যায় দর্শন ও প্রজ্ঞার।
এমন কোনো বাক্য কি বলবেন দার্শনিকদের যা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও উপদেশমূলক। জনাব দিইনানি এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, একটি বাক্য সবাইকে প্রশান্তি দেবে এমন কিছু আমার জানা নেই। আমাদের সবারই উচিত বাস্তবতা তথা সত্যের জন্য তৃষ্ণার্ত হওয়া। বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের ফার্সি সাহিত্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ। কেবল একটি পয়েন্ট বা দিক বলা হবে আর তা সবাই গ্রহণ করবে বাস্তবতা এমন নয়।
আপনার মতামত লিখুন :