আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমাদের পারিবারিক শান্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য শিশুদের আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ইসলাম প্রত্যেক মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ ও সন্তানের); সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এক কথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।’ (বুখারি : ৭১৩৮)।
পবিত্র কুরআনে যেমন নিজে বাঁচার কথা বলা হয়েছে, তেমনি পরিবারের বিষয়েও তাগিদ রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম :৬)। এর ব্যাখ্যায় আলী (রা.) বলেন, ‘অর্থাৎ তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শেখাও’। প্রখ্যাত দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘জেনে রাখ, শিশু লালন পদ্ধতি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছে আমানতস্বরূপ। তার পবিত্র অন্তর আধারস্বরূপ, যা কোনো নকশা বা ছবি থেকে মুক্ত। ফলে তা যে কোনো নকশা গ্রহণে প্রস্তুত এবং তাকে যার প্রতিই ধাবিত করা হবে, সেদিকেই ধাবিত হয়। তাই তাকে ভালোয় অভ্যস্ত করা হলে, সুশিক্ষায় প্রতিপালন করলে সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। ইহকালে ও পরকালে সে সুখী হবে। তার নেকিতে তার বাবা-মা এবং প্রত্যেক শিক্ষক ও শিষ্টাচারদানকারীই অংশীদার হবেন। পক্ষান্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তার সুশিক্ষায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর’। (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ৩/৬২)।
হজরত লুকমান (আ.) তার নিজ সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে তা অনুসরণ করার জন্য পবিত্র কুরআনে হুবহু তা তুলে ধরেছেন। হজরত লুকমান তার স্নেহধন্য পুত্রকে যে উপদেশগুলো দিয়েছেন তা হলো-লুকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল-হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা-অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না, তবে দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে এবং যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদের অবহিত করব। হে বৎস! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সবকিছুর খবর রাখেন। হে বৎস! নামাজ কায়েম করো, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ কর না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।-[সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩-১৯]।
প্রত্যেক বাবা-মা অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের সঠিক পরিচর্যা করা। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের আলোকে তাদের সুশিক্ষায় গড়ে তোলা। তাহলে ইহকালীন জীবনে যেমন আদর্শ সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ পাওয়া যাবে, তেমনি পরকালীন জীবনেও মিলবে মুক্তি। বলা বাহুল্য, পরিচর্যা যা করার প্রতিটি জিনিসের প্রাথমিক পর্যায়েই তা করতে হয়। সঠিক সময়ে তা করতে না পারলে পরবর্তী সাময়ে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। শিশুকালে বাচ্চাদের মন-মানসিকতা যে অবস্থায় থাকে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আর তা সে পর্যায়ে থাকে না। সুতরাং শিশুর মনোদৈহিক উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা লাভের জন্য যা প্রয়োজন অর্থাৎ খাদ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন ও ইসলামি সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এতে মূল্যবোধ, সুকুমারবৃত্তি ও মানবিক গুণাবলির প্রকাশ ঘটে। সভ্যতার উন্নয়নে বিশ্বনাগরিক সৃষ্টিতে শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল ও যত্নবান হতে হবে। সূত্র : যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন :