ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] খোলা বাজার ও আনুষ্ঠানিক বিনিময় হারে এতোটা পার্থক্য থাকলে কি ‘হুন্ডি’ নিয়ন্ত্রণ আদৌ সম্ভব?
ড. আতিউর রহমান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক : খোলা বাজারে ডলারের যে রেট সেটা যদি অফিসিয়াল রেটের এক দুই শতাংশের মধ্যে থাকে, তাহলে খুব একটা চিন্তা করার বিষয় নয়। আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা যারা আছে তখন তারা সচেতন সিদ্ধান্ত নেবে। বলবে, আমরা হুন্ডির মাধ্যমে যে টাকাটা পাঠাচ্ছি সেটা কোথায় যাচ্ছে। এই টাকাটা দিয়ে কেউ ডাকাতি করছে কিনা, কেউ মাদক কিনছে কিনা, কেউ পুঁজি পাচার করছে কিনাÑ সেটা তো তারা জানে না। তার মাথার মধ্যে যদি এটুকু ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যে, সামান্য কিছু টাকার জন্য তার পাঠানো হুন্ডির টাকা দেশ ও সমাজের ক্ষতি করছে, তাহলে সে হুন্ডি করতে পুনর্বিবেচনা করবে। এরকম একটি তথ্য ক্যাম্পেইন করতে হবে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে যারা হুন্ডি করছে তারা কিন্তু ঘরে গিয়ে টাকটা দিচ্ছে, তাই পক্রিয়াটি খুব সহজ। আমরাও যারা আনুষ্ঠানিক টাকা লেনদেন করতে চাচ্ছি, ডলারের বিনিময়ে আমাদেরও সহজ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের একজন শ্রমিক তার ক্যাম্পে বসেই যেন অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাংকের সঙ্গে মোবাইল ফাইন্যান্স মিলিয়ে তারা যেন ঘরে বসে সেই টাকা তাদের আত্মীয়দের কাছে সহজেই পাঠাতে পারে, সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। হুন্ডিওয়ালারা যেভাবে সহজে আর্থিক সেবা দেয়, আমরা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহজে সেই সেবা দিতে পারি তাহলে লোকে এক দুই টাকার জন্য অনানুষ্ঠানিক পথে যাবে না। এর জন্য একটা ক্যাম্পেইন করা দরকার যে ‘আপনি দেশপ্রেমী, আপনি দেশের জন্য কাজটা করেন। আমরা তো আপনাকে সমান সুবিধাই দিচ্ছি।’ সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে এরকম একটি অর্থনৈতিক সঙ্কটকালেও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো আরও আড়াই শতাংশ দিচ্ছে। অর্থনীতিতে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কম নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে নমনীয় এক্সচেঞ্জ রেটগুলো করলে, বাজারকে খানিকটা মুক্তি দিলে আমার ধারণা ম্যাক্রো ইকোনোমিতে আপাতত যে খানিকটা টানাপোড়ন চলছে, সেটা ঠিক করা খুব কঠিন হবে না। এজন্য আমাদের দরকার সাহস এবং নীতি সমন্বয়। আর্থিক খাতের সঙ্গে রাজস্ব খাতের আরও গভীর সমন্বয়। একইভাবে প্রযোজ্য।
[৩] বাংলাদেশে কৃষিতে যেমন প্রণোদনা দেওয়া হয় তা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. আতিউর রহমান : আমার মনে হয় বাংলাদেশের সরকার কৃষিতে যতো মনোযোগী আর কোনো দেশের সরকার এতোটা মনোযোগী নয়। গত কয়েক বছরে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে সরকার কৃষির জন্য। পুরো কোভিডকালে আমরা লক্ষ্য করেছি, কৃষির জন্য কীভাবে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রতিটি বাজেটে অন্যান্য প্রণোদনার অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে প্রণোদনা কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কৃষি গবেষণায় যথেষ্ট বিনিয়োগ করা হচ্ছে। যে পরিমাণে আমাদের কৃষিতে নতুন নতুন জাতের ফসলের উৎপাদন হচ্ছে। সবজি, মাছ, মাংস, চাল, ডাল প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদন বেশ বেড়েছে। আমাদের যেটি সমস্যা হয়েছে সেটি হলো কিছু কিছু পণ্য আমরা এখনো সেভাবে উৎপাদন করতে পারিনি। তাই ডাল বেশি করে আমদানি করতে হয়, ভোজ্য তেল আমদানি করতে হয়, গম আমদানি করতে হয়। কোভিডের পর থেকে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে বড় সংকট তৈরি হয়েছে এই আমদানি বাণিজ্যেই। এ কারণে তৃতীয় বৃহত্তম খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৈরি হয়েছে। এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। স্বদেশী কৃষি উৎপাদনে আরও জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কৃষকরা কিন্তু বড় উদ্যোক্তা। কৃষকদের একটু সুবিধা দিতে পারলে তারা এ কাজটি খুব ভালোভাবে করবে। পেঁয়াজ নিয়ে যে লঙ্কাকাণ্ড হলো, আমাদের কৃষকরা কি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারে না? আরও একটুু প্রণোদনা দিলেই তারা তা পারে। আমরা তো লক্ষ্য করেছি ২০০৯-১০ এর দিকে কৃষককে আমরা ২ শতাংশ করে ঋণ দিতাম, যার মাধ্যমে কৃষিতে তারা পেঁয়াজ, রসুন, আদা এগুলো উৎপাদন করতে পারতো। বাজেট থেকে বাকি যে রেট অব ইন্টারেস্ট সেটা ভর্তুকি দেওয়া হতো। এটা বাজেটেরই একটা পলিসি ছিলো। শুধু আমরা নিবিড়ভাবে বাস্তবায়ন করেছি। তার সুফলও পেয়েছি। এর ফলে আমরা লক্ষ্য করলাম পার্বত্য চট্টগ্রামে হলুদ হচ্ছে, আদা, রসুন হচ্ছে, পাবনাতে বিরাট কৃষি পল্লী গড়ে উঠছে।
[৪] আমাদের পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ছে। এই পলিসি ফুটপ্রিন্টগুলো কিন্তু আমাদের আছে। তবে এগুলোর দিকে আরও বেশি করে নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কৃষির জন্য যে পরিমাণে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে সেগুলো যদি দেশে আমরা উৎপাদন করতে পারি তাহলে আমাদের এই আমদানি খরচ কমে আসবে। তবে আমদানি কিছুটা থাকবেই। আমদানি ছাড়া উন্নত দেশও চলতে পারে না। আমরাও খাদ্যের কিছু অংশ আমদানি করতে পারি। কিন্তু এর জন্য আমরা কৃষিতে আরও কিছু সমর্থন দিতে পারি। যেমন পেঁয়াজ, আলু, রসুন এগুলো আমদানির জন্য আমরা পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে একটা ‘কোটা সিস্টেমে’ যেতে পারি। নির্দিষ্ট বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ আমদানি আমরা করবোই। এক্সপোর্টের ওপর তারা যে নিষেধাজ্ঞা দেন তার বাইরে...এই চুক্তির মধ্যে থাকা কৃষি পণ্য। আমার মনে হয় এরকম একটা অর্থনৈতিক আলাপ আলোচনা আরও নিবিড়ভাবে শুরু করা উচিত। এই লক্ষ্যে একটা স্মারক আমাদের স্বাক্ষরিত হওয়া উচিত। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে যখনই ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি তারা বলেন, এরকম একটা কোটা সিস্টেম দাঁড় করানো অবশ্যই সম্ভব। যাতে করে বাংলাদেশের ভোক্তারা কোনো বিপদে না পরে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এক্সচেঞ্জ রেটের ওঠানামা ও বাংলাদেশের ভেতরের রাজনৈতিক অস্থীতিশীলতার কারণে একটা ছোট্ট গ্রুপ (যেটাকে অনেকেই বলে সিন্ডিকেট) একধরনের স্বার্থান্বেষী ব্যবস্থা করে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে একধরনের প্রতিকূল অবস্থা দাঁড় করায়। বাজার ব্যবস্থাপনা সেজন্য আরও উন্নত হওয়া উচিত এবং এগুলো মনিটরিং করা উচিত। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশনের এ কাজে সক্রিয় থাকা উচিত। মনিটরিং জোরদার করার জন্য একটি এগ্রিকালচারাল প্রাইজ কমিশনও করা যায় কিনা সেই বিষয়টি ভাবা উচিত। ভারতে কিন্তু এ ধরনের কমিশন আছে। সেখানো কোন পণ্যের দাম কতো হতে পারে একটা প্রক্ষেপণ করে এই কমিশন। তাদের একটা বিশেষজ্ঞ টিম আছে তারা সেটা দেখে। আমার মনে হয় এই কাজগুলো আমাদেরও করা উচিত।
[৫] আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কৌশলের বাস্তবায়ন কতোটা হলো?
ড. আতিউর রহমান : আগামীতে আমাদের সোশ্যাল সেফটি নেট আরও বিস্তৃত করতে হবে। কিন্তু একথাও ঠিক এটা খুব সহজ নয়। আমাদের সরকার একটা সোশ্যাল সেফটি নেট কৌশল তৈরি করেছে। এই স্ট্র্যাটিজিটা বাস্তবায়ন করতে আমাদের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে এটার সম্পর্ক আরও গভীরতর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও কিছু কিছু লিকেজ হচ্ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বারÑ সে হয়তো একজন গরিব, বয়স্ক মানুষের ভাতাটা ঠিকই দিচ্ছে, কিন্তু তার সিমটা হয়তো সে নিয়ন্ত্রণ করছে। তখন তার কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে নিচ্ছে। এই লিকেজগুলো বন্ধ করা যায়। এগুলো ডিজিটালি মনিটরও করা যায়। এই এজেন্টরা কাকে কাকে টাকা দিচ্ছে, একই সময়ে কি দশটা পেমেন্ট হয়ে যাচ্ছে একই সিমের নাম্বারে? ডিজিটাল পদ্ধতিতে লোকাল যে ইউএনও আছেন তিনি এটি মনিটরিং করতে পারেন। যাদের টাকাটা পাওয়ার কথা তারা কয় টাকা পেলো এবং তারা এই পেমেন্টটা নিলো কিনা নাকি অন্য কেউ নিলো এগুলো দেখা সম্ভব। এই লেনদেনের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট খুঁজে বের করা যায়। এরজন্য সামাজিক দায়বদ্ধতাও তৈরি করা যায় সামাজিকভাবে। আমরা যেমন কৃষি লোন দেওয়ার সময় গ্রামে-গঞ্জে ওপেন ফোরাম করতাম। সবার সামনে সবকিছু করতাম। যিনি কৃষক না তিনি যদি এই টাকাটা নিতে আসেন তখন সাধারণ মানুষই বলতো, ও তো কৃষক নয়, ওকে কেন টাকাটা দিচ্ছেন? স্বচ্ছতার এই পদ্ধতিটি দাঁড় করাতে পারলেই এসব ঠেকানো সম্ভব। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আরও জোরদার করা উচিত। এই যে ট্রাক সেল করছি আমরা পণ্যগুলো এটা সাময়িক ব্যবস্থাপনা। এতে মানুষের খানিকটা সুবিধা হচ্ছে। কিন্তু শুধু সামজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভর না করে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। এই শহরের প্রত্যেকটা ওয়ার্ড ভিত্তিক কিছু রেশন শপ তৈরি করতে পারি না যেখান থেকে রিকশাওয়ালা তার কার্ড নিয়ে সুবিধামতো সময়ে প্রয়োজনীয় পণ্যটা নিতে পারে। সারাদিন ট্রাকের পেছনে বসে থেকে তার তো সময় নষ্ট হয়। তার সময় অত্যন্ত মূল্যবান। এই জিনিসগুলো আমাদের মনে হয় এখন ভাবতে হবে। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিক সুরক্ষাটাকে সাজাতে হবে।
[৬] শিক্ষিত তরুণদের জন্য ‘স্টার্টআপ’ সুযোগ কতোটা বাড়াতে পেরেছি?
ড. আতিউর রহমান : ভারতে গত ৩-৪ বছরে এক লাখেরও বেশি স্টার্টআপ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাদের স্টার্টআপ ইকোলজি এমনভাবে সহজ করে ফেলেছে যে কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চায় তাকে নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। স্টার্টআপের জন্য যে তহবিল আছে সেখান থেকে তারা সহজে অর্থ নিতে পারে। অর্থটা বড় নয়, স্টার্টআপের জন্য তাদের পরিবার থেকে সমাজ থেকে, সরকার থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটাই বড় বিষয়। আমাদের এখানেও অনেক নতুন নতুন স্টার্টআপ তৈরি হচ্ছে। বেশির ভাগ স্টার্টআপ পরিবার থেকে হচ্ছে। বাবা-মা যদি একটা ছেলে বা মেয়েকে সহযোগিতা করেন তারা যদি বলেন নিজে থেকে কোনো কিছু দাঁড় করাও, ফেল করলেও কোনো সমস্যা নেই, তাহলেই স্টার্টআপ তৈরি হয়। আমাদের এঞ্জেল ক্যাপিটালিস্ট যারা আছেন তাদের আমি অনুরোধ করবো যেসব ছেলেমেয়েরা বিদেশ চলে যেতে চায় তাদের ঠেকান এবং তাদের ঠেকানোর একটাই উপায় তাহলো তাদের স্টার্টআপের মধ্যে ইনভলব করা। তাদের পুঁজি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে সহযোগিতা করুন। তারা নিজেরা কাজ করবে অন্যদের চাকরি দেবে সেরকম এক বিপুল সম্ভাবনার ক্ষেত্র আমরা স্টার্টআপের মাধ্যমে তৈরি করতে পারি। বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক স্টার্টআপ ফান্ড তৈরি করেছে। কিন্তু এটাকে অনেক সময় ঋণের মতো মনে হয়। স্টার্টআপ তহবিল কিন্তু কোনো ঋণ নয়, এটা একটা বিনিয়োগ। পাঁচ বছর বা দশ বছর মেয়াদী বিনিয়োগ। সেখানে তারা ফেল করলে করবে। কিন্তু তাদের সহযোগিতা করা দরকার। বিকল্প উৎসগুলো খোলার ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
[৭] কানেক্টিভিটির প্রভাবের কথা শুনতে চাই। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাবনার জায়গাটা কী
ড. আতিউর রহমান : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার সবচেয় বড় যে দিকটি সেটি আমরা আলরেডি স্থাপন করে ফেলেছি। সেই ভিত্তিটি হলো আমাদের রাস্তাঘাটের কানেক্টিভিটি। আমাদের এই ছোট্ট একটি দেশে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভবনার দিকটি হলো ডেনসিটি। ডেনসিটি অফ দ্য রোডস অ্যান্ড ডেনসিটি অফ দ্য পপুলেশন। অর্থাৎ এতো কম জায়গায় একমাত্র হংকং ছাড়া আর কোনো জায়গায় এতো মানুষ বাস করে না। ঘন ঘন মানুষ বাস করার একটা সুবিধা আছে সেটি হলো মার্কেট খুব বড় হয়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য নেওয়া লাগে না। মানে বাজার ঘন হয়। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে, আমাদের ডেমোগ্রাফিক যে অপর্চুনিটি সেটি বেশিদিন টিকবে না। আমাদের পরিবার প্রতি ৭ জন সন্তান হতো ৫০ বছর আগে, এখন সেটা ২ জনে নেমে এসেছে। এবং তাদেরও একটা বিরাট অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের কিন্তু ডেমোগ্রাফিক সংকোচন শুরু হয়ে গেছে। আগামী দশ-বিশ বছরের মধ্যে যদি আমরা জনশক্তির সদ্বব্যবহারের এই সুবিধাটা না নিতে পারি, তরুণরা যদি দেশ ছেড়ে চলে যায় এবং সন্তান সংখ্যা যদি এভাবে কমতে থাকে তাহলে যেই সুযোগটা আমরা এখন পাচ্ছি সেটা আর পাবো না। এজন্য আমাদের সম্ভাবনাটা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের শিক্ষার, প্রশিক্ষণ, আর আমাদের উদ্যোক্তাদের ওপর খুব বেশি করে নজর দিতে হবে। অন্য জায়গায় আমরা রাস্তাঘাট তৈরি করে ফেলেছি, আমাদের রেল কানেন্টিভিটি হয়ে গেছে, গ্রামে-গঞ্জে ডিজিটাল ফাইন্যান্স পৌঁছে গেছে।
[৮] মোবাইল ব্যাংক, এজেন্ট ব্যাংক, ব্যাংকের শাখা-উপশাখা সব পৌঁছে গেছে। আমরা প্রস্তুত। এখন শুধু একটা ভরসার জায়গা তৈরি করা দরকার। তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে হবে। কোভিডকালে নতুন ১২-১৩ লাখ নতুন ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরি হলো ফেসবুক বেইজড। তারা কি আদৌ এই ১৫-২০ হাজার টাকার ‘ন্যানো ক্রেডিট’ পায়। কয়টা ব্যাংক তা দেয়? তাদের অনেকসময় বলা হয় তাদের ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাদের যদি একটা এনআইডি থাকে, ব্যাংক একাউন্ট থাকে সেটিই আপাতত দুই বছরের জন্য যথেষ্ট। এই দুই বছরের মধ্যে যদি অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স করার সুযোগ করে দেওয়া যায় তাহলেই তারা দাঁড়িয়ে যাবে। আমরা অন্যান্য ক্ষেত্রে এখন স্মার্ট সেবা পাচ্ছি। তাহলে এক্ষেত্রে কেন তারা তা পারে না? আমার মনে হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থ উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি একটা স্মার্ট প্রশাসন, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সমাজ করবেন এবং স্মার্ট জনশক্তি তৈরি অঙ্গিকার এবারের নির্বচনি ইশতেহারে দিয়েছেন। এবারের স্মার্ট বাংলাদেশের ক্যাম্পেইনটা সত্যি সত্যি অর্থবহ করার জন্য প্রতিটি বাজেটে, প্রতিটি পরিকল্পনায় এবং প্রতিটি পার্সপেক্টিভে প্ল্যানেরও লক্ষ্য হতে হবে এই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার বাস্তবানুগ পথনকশা।
[৯] আমাদের শক্তির উৎসগুলো কোথায়?
ড. আতিউর রহমান : আমাদের অর্থনীতির বড় শক্তি কৃষি। কৃষি যতো ভালো করবে আমাদের অর্থনীতি ততো ভালো হবে। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি হলে দারিদ্রতা কমবে। আমাদের আরেকটি শক্তির জায়গা হলো আমাদের দেশে শুধু রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের বাইরেও অসরকারি খাত আছে। ব্যক্তি খাত আছে। সবাই মিলেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই বিগ পার্টনারশিপের কনস্পেটটা আমরা আরও বেশি করে এগিয়ে নিয়ে যাবো। আমাদেরই একমাত্র দেশ যেই দেশে মাইক্রোফাইন্যান্স রেভুলেটরি আছে। নেপাল, ভারতে নেই। আমাদের ‘এমআরএ’ বলে একটি রেগুলেটর অথরিটি আছে। যারা প্রায় সেন্ট্রাল ব্যাংকের মতোই। তাদেরও তথ্যভান্ডার চালু হতে যাচ্ছে। তারাও ব্যাংকের মতো মাইক্রো ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউটগুলোকে সঞ্চয় কতো হবে, বিনিয়োগ কতো হবে, কোথায় করতে হবে তা বলে দেয়। সুতরাং আমাদের গ্রামীণ অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনা আছে। এই জায়গাগুলোর দিকে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়তো হলো আমাদের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে এটিও একটি বিরাট সম্ভবনার দিক। কিন্তু এই বিদ্যুৎ খাত আমরা যেন এমনভাবে পরিকল্পনা করি যাতে আমাদের চাহিদাগুলো যেভাবে বাড়বে সেভাবেই যেন সরবরাহও বাড়ে। যদি সাপ্লাইয়ের সুযোগ অনেক বাড়িয়ে ফেলি চাহিদা কিন্তু তার না থাকে তাহলে আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। তাই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়। তখন এটা আর ভায়বল থাকে না। সুতরাং একটা সাসটেইনেবল এনার্জি পলিসি আমাদের থাকতে হবে যেখানে সবুজ জ¦ালানিরও একটা বিরাট সুযোগ থাকতে হবে।
[১০] তৃতীয়তো সম্ভাবনার আরেকটি দিক হলো তারুণ্য। এই তারুণ্যকে ধরে রাখতে হবে। এর মধ্যে একটা জরিপ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে ৪২ শতাংশ তরুণ বাইরে চলে যেতে চায়। তরুণরা বলে এখানের পরিবেশ ভালো না। কীসের পরিবেশ? তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ বলে দুর্নীতি ও অনিয়ম তাদের নিরুৎসাহিত করে। তাই, আমাদের এই পরিবেশও উন্নতি করতে হবে। ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে আমরা স্বচ্ছ একটা প্রশাসন ব্যবস্থা গড়তে পারলে জবাবদিহিতা বাড়বে এবং দুর্নীতিও কমবে। আরেকটা হলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করা, জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা। এই অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে এবং একইসঙ্গে ম্যাক্রো ইকোনোমির কার্যকরি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের সম্ভবনার খাতগুলো আরও প্রসারিত হবে।
[১১] নতুন সরকারের জন্য কোনো সংস্কারের পরামর্শ দেবেন কি?
ড. আতিউর রহমান : যে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা আমি বললাম এগুলো স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। নতুন সরকারের জন্য জরুরি যে চ্যালেঞ্জটা হবে, সেটি হলো সম্পদ আহরণ। তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে রেভিনিউ কতোটা আসছে, রেমিট্যান্সের প্রবাহটা যেন নিশ্চিত থাকে, এক্সপোর্ট যেন নিশ্চিত থাকে আর আমদানি যেন নিয়ন্ত্রিত অবস্থা থাকে। এই চারটা জিনিস একসঙ্গে করতে চাইলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কোঅর্ডিনেশনের। এরজন্য সবচেয়ে জরুরি অর্থনীতির বিচক্ষণ নেতৃত্ব। অর্থনীতিতে এমন নেতৃত্ব সরকারের লাগবে যেটা সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে এবং একটা ভরসার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। উদ্যোক্তারা যাতে ভাবেন যে আমরা বাংলাদেশে ইনভেস্ট করতে পারি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও যাতে বাংলাদেশের উপর ভরসা রাখতে পারে এরকম একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারি। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক নেতৃত্বটাকেও সেই মানের হতে হবে। তাহলেই আমরা একটি সম্ভাবনার বাংলাকে, সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো।
শ্রুতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস
আইএফ
আপনার মতামত লিখুন :