ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] আমাদের অর্থনীতি: ২০২৩ সালটি প্রবৃদ্ধির বিচারে কেমন গেলো?
ড. আতিউর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক : ২০২৩ সাল শুধু আমাদের জন্যই নয়, পুরো বিশ্বের জন্যও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং একটি বছর ছিলো। এ বছর বিশ্বের অর্থনীতি নানাভাবেই প্রভাবান্বিত হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়েনি বরং কমেছে। বিশ্বের প্রবৃদ্ধির হার ২০২৩ সালে ৩ শতাংশ বেড়েছে বা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সময়ে বাংলদেশের প্রবৃদ্ধিও ৬ শতাংশ হবার কথা। ফলে বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশ মন্দ করেনি। প্রায় দ্বিগুন হারে বেড়েছে। তবে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হবে বলে এই অর্থ বছরে আশা করা হয়েছিলো। অর্থবছরের অর্ধেকটা সময় এখনও বাকি আছে। আমরা আশা করছি, নির্বাচনের পরপরই যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়, তাহলে অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে। তখন নিশ্চয়ই প্রবৃদ্ধির হার আরেকটু বাড়বে। কিন্তু আইএমএফ বলছে, এবার ৬ শতাংশের মতো আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সামনের বছরের জন্যও তারা ৬ শতাংশ পূর্বাভাস দিয়েছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমি বলবো না, বিশ্ববিচারে আমাদের অর্থনীতি খুব খারাপ করছে। যদিও আরও ভালো করার স্বপ্ন আমাদের ছিলো। সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করার কথা আমাদের বাজেটে বলা ছিলো। সরকার নিজেও এই প্রক্ষেপণ খানিকটা কমিয়েছে। তবুও সরকার বলছে, এই হার ৭ শতাংশের মতো হবে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ৬ শতাংশের মতো, আইএমএফ-ও বলছে ৬ শতাংশের মতো, এডিবি বলছে সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। সুতরাং আমাদের ৭ শতাংশ, আর তাদের ৬ বা সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাদেরও আমাদের প্রক্ষেপণে আধা শতাংশ থেকে এক শতাংশের মতো ব্যবধান বরাবরই হয়ে থাকে। তার মানে এতো সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ গতিময়ই রয়েছে।
[৩] বিশ্বায়ন বিপর্যস্ত হবার কারণে আমাদের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়েছে?
ড. আতিউর রহমান: আমরা এখন বিশ্বায়নের অংশ। যে যাই বলুক, এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় সংযোগ পশ্চিমের সঙ্গে। আমাদের এক্সপোর্ট বা রেমিটেন্সÑ সবকিছুই মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমাদের সঙ্গে। বিশেষ করে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তির যে উৎস তাহলো আমাদের রপ্তানি। আমাদের ম্যানুফেকচারিং খাতেরই আরেকটি রূপ হলো আরএমজি সেক্টর। সেই জায়গাটি অনেকটাই পশ্চিমের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আমাদের অন্যতম চাহিদার ক্ষেত্র হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানি খাত কিছুটা আমরা ডাইভার্সিফাই করেছি। জাপান, রাশিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশ থেকে এখন বেশ কিছু রপ্তানি আদেশ পাচ্ছি। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট এখনও সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। যখন বিশ্ব ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই-চেইনে গত কয়েকমাস যাবৎ শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নানা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও রপ্তানি সচল রেখেছে। চলতি বছরে ইউরোপে নিট রপ্তানিতে আমরা চীনকে টপকে এক নম্বরে উঠতে পেরেছি। তবে গত দুই মাস আমরা বড় ধরনের হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এতে সাধারণ মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশ হারে বাড়বে বলে আশা করছি। আন্তর্জাতিক সংস্থাদের প্রক্ষেপণ ৬-৬.৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে বাংলাদেশর অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জিং দিকটি সেটিও মনে রাখতে হবে। সেটি হলো আমাদের মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে জুড়ে আমাদের বড়ই বিড়ম্বনার মধ্যে রেখেছে। ৯ শতাংশেরও বেশি মূল্যস্ফীতি আমাদের মতো দেশের জন্য মোটেও কাক্সিক্ষত নয়। এর কারণে সামাজিক পাটাতনের নীচের দিকে থাকা মানুষগুলোর জীবন চলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের আমদানি মূল্য বেড়ে যায়। এর প্রভাবে টাকার দাম কমে গেছে। ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। সমাজে এসবের প্রভাব পড়েছে। কোভিড-উত্তর সময়ে হঠাৎ বিশেষ করে যারা সমাজের নিচের দিকের মানুষ, যাদের আয় রোজগার খুব কম, তাদের জন্য জীবনচলা খুবই কষ্টকর হয়ে গেছে।
[৪] ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি গতি প্রকৃতি কেমন হবে?
ড. আতিউর রহমান: ২০২৪ সালের মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বলছেÑ খানিকটা কমবে। কিন্তু তারা যে অঙ্কটা করছে সেটা বলছে যে তা ৭.৯ শতাংশের মতো হবে। কিন্তু আমাদের হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্স বলছে তা হবে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। আমি জানি না তারা এই হার আসলেই অর্জন করতে পারবে কিনা। কারণ ৯ থেকে ৬ এ নামিয়ে আনাটা খুব কঠিন হবে। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে যে ধরনের সংস্কার দরকার আমাদের, সেটা কিন্তু সহজ হবে না। তবুও সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। যেমন আমাদের মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার সবচেয়ে নির্ভরশীল পদ্ধতি হলো মনিটরি পলিসিকে সংকুচিত করা। মনিটরি পলিসি সংকুচিত করতে গেলেই রেট অব ইন্টারেস্ট বাড়বে। রেট অব ইন্টারেস্ট যখন বাড়বে তখন প্রবৃদ্ধির ওপর একটু চাপ পড়বে। অনেকসময় আমরা এই সাময়িক চাপটাও গ্রহণ করতে পারি না। বিশেষ করে যারা উদ্যোক্তা শ্রেণি তারা সবসময় বাজারের মুক্তি বা স্বাধীনতা মেনে নিতে চান না। বরং রাষ্ট্রকে অনেকসময় তারা তাদের স্বার্থে প্রভাবান্বিত করতে চায়। তাদের প্রচেষ্টা থাকে যে বাজার যেন তার মতো করে চলতে না পারে। যার কারণে বাজারটা অস্থীতিশীল হয়ে ওঠে। আর অস্থীতিশীল পরিস্থীতিতে মনিটরি পলিসি টাইট করা খুব কঠিন। তবুও বলবো যে এই মুহূর্তে আইএমএফের পলিসি প্রেসক্রিপশন আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসি নীতিমালা আছে। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে। সবাই এই মূল্যস্ফীতি নামের বড় শত্রুটাকে বাগে আনার চেষ্টা করছে। তাই আমার ধারণা পুরোপুরি না হলেও মূল্যস্ফীতি খানিকটা তো কমবেই। এখন ৯ শতাংশ আছে, জুন মাসের নাগাদ এটা ৭-সাড়ে ৭ এর মধ্যে তো চলে আসবেই বলে আমার বিশ্বাস। মনিটরি পালিসি ছাড়াও সাপ্লাই সাইডের একটা বিষয় আছে। যদি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে, যদি জিও-পলিটিক্সের আরও পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে আমদানি করা জিনিসপত্র আসতে সমস্যা হবে। তার একটা প্রভাবতো মূল্যস্ফীতির ওপর তখন পড়বেই। আমার ধারণা ২০২৪ সালও ২০২৩ সালের মতো একটা টার্বুলেন্ট বছরই যাবে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। তবে নির্বাচনের পর উপযুক্ত সংস্কার করা গেলে এই টানাপোড়েন নিশ্চয়ই সামাল দেওয়া যাবে।
[৫] এই মুহূর্তে তাহলে আমরা কোন দিকে হাঁটবো মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল নাকি প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিময় করবো?
ড. আতিউর রহমান: আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল করাটাই প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল করার সুযোগ পাওয়া গেলে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সুযোগও বাড়বে। সুতরাং এই মুহূর্তে স্ট্যাবিলিটি আমাদের কাছে পয়লা নম্বরের লক্ষ্য, প্রবৃদ্ধি নয়। তাই, প্রবৃদ্ধি একটু কমলেই মন খারাপ করার কিছু নেই। সারা বিশ্বের প্রবৃদ্ধিই কমছে। সেই জায়গায় প্রবৃদ্ধির হার যদি একটু কমে তার বিনিময়ে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল করতে পারি সেটা ভালোই হবে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার আরেকটি কারণ হলো আমাদের টাকার মান প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে গত এক দেড় বছরে। এর পেছনে বড় কারণ হলো ডলার শক্তিশালী হয়েছে। আবার সেটাও আন্তর্জাতিক ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হারের কারণে হয়েছে। তারা মনিটরি পলিসিকে সংকোচিত করে চলেছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। তাতে করে তাদের ডলারের দাম বাড়ছে। আর তাদের বন্ডগুলোও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মতো বিকাশমান দেশ থেকে ওদের দেশে ডলার চলে গেছে। আমরা আগের মতো সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছি না। ডলার চলে যাবার কারণে আমাদের ডলার-টাকার মানে বড় ধরনের হেরফের হয়ে গেছে এবং এটা সরাসরি মূল্যস্ফীতিতে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। এই যে টাকার মান কমে গেলো তাতে আমাদের আমদানি করা পণ্যগুলো বিশেষ করে গম, ভোজ্য তেল, ফার্টিলাইজারের দাম টাকায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এই একটি কারণে যখন বাজারে আমদানি করা একটি পণ্যের দাম বাড়ে তখন আমাদের দেশের ভেতরে তৈরি করা পণ্যের দামও বাড়ে। সুতরাং এরকম একটি জটিল পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনা নিশ্চয় কঠিন বিষয়। আমার মনে হয় আমরা আরও শক্তভাবে আগে থেকে বিনিময় হারটা নমনীয় করতে পারতাম তাহলে হয়তো পরিস্থিতির এতোটা অবনতি হতো না। আমরা শুনে খুশি হয়েছি যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিশ্বে যে পার্টনার আছে আমাদের তারা সবাই মিলে বাজার নির্ভর এক্সচেইঞ্জ রেট করিডোর তৈরি করতে চাচ্ছে। আমাদের ফরেইন এক্সচেঞ্জে এক্ট আছে। সেই এক্টেও ২ শতাংশ পর্যন্ত একটা ব্যান্ড তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ আজকের বাজারে ডলার মূল্য যদি ১১৫ টাকা ধরি তাহলে এর ২ শতাংশ আমি উপরেও উঠতে পারবো আবার ২ শতাংশ নিচেও নামতে পারবো। সুতরাং এর বাইরেও আমাদের রেগুলেশন করার সক্ষমতা আছে। এই জায়গাটিতে আমাদের খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার ধারণা জানুয়ারি মাসে যে মনিটরি পলিসি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সেখানে ‘ক্রলিং পেগের’ পক্ষে হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত দেবে। যদি দেয় তাহলে বর্তমানের অনেকগুলো বিনিময় হারকে একটা জায়গায় আনার চেষ্টা চলবে। এর জন্য বড় রকমের সংস্কার দেখানোর সাহস দেখাতে হবে।
[৬] তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বহিঃঅর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে পারছে না কেন?
ড. আতিউর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতার কথাও বুঝতে হবে। আমাদের অর্থনীতি এখন খুবই ‘গ্লোবালাইজড’। বিশ্বঅর্থনীতির এতো দ্রুত পরিবর্তন হবে তা অনুমান করতে পারিনি আমরা। আমাদের আমদানি হঠাৎ কোভিডের পর এক বছরেই ৮৯ বিলিয়ন ডলার হবে তা আমরা কখনো ভাবতে পারিনি। যদিও এখন তা কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হালে কতোগুলো শক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এর মূল্যও গুনতে হচ্ছে আমাদের। জোর করে যখন আমদানি কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে তখন এর প্রভাব কাঁচামালের আমদানির ওপর পড়ছে। ছোটখাটো যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর পড়ছে। ডলারের একধরনের সঙ্কটের কারণে মোট আমদানি প্রায় ১৬ শতাংশ পড়ে গেছে। যদি এই নিয়ন্ত্রণ বিলাসবহুল পণ্যের ওপর করতো তাহলে এতো দুশ্চিন্তার কারণ ছিলো না। কিন্তু আমরা দেখলাম গত এক বছরে মার্সিডিজ কিংবা অডি গাড়ির আমদানি আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো শুধু তাদের মার্জিন বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধ করতে পারেনি। বন্ধ করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলে এমন বিলাসপণ্য আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ করতে পারে। একটা খোলামেলা মার্কেট হঠাৎ বন্ধ করাও খুব কঠিন কাজ। আমাদের ভোক্তাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। সবকিছু বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার করে দেবে! আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই! এমন সংকটকালেও কেন এতো দামি গাড়ি তারা আমদানি করছেন?
আমি দেখলাম নেপাল গত একবছরে একটা মার্সিডিজ গাড়িও আমদানি করেনি। অথচ তাদের ১১ মাস আমদানি করার মতো রিজার্ভ আছে। তবু তারা যদি এতোটা সাশ্রয়ী হতে পারে আমরা কেন পারবো না। আমাদের ভোক্তারা শুধু ভোগ করবে, বিলাস করবে, আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দোষ দেবে এটা তো হতে পারে না। সবাই মিলে ভাবতে হবে। তবে আমাদের হাতে অবশ্যই অস্ত্র আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেও আছে, কমার্স মিনিস্ট্রির হাতেও আছে। এই অস্ত্রগুলো প্রয়োগ করলে আমার মনে হয় এই বিলাবহুল পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এটা করলে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ভারসাম্য উন্নত করা সম্ভব। ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অনেকদিন পরে যে সমস্যাটা দেখা দিলো সেটা ফাইনেন্সিয়াল একাউন্টে ঘাটতি। অর্থাৎ আমাদের বিদেশি মুদ্রার নীট আউটফ্লো বেড়ে গেছে। তার মানে আমরা বিদেশ থেকে যে এফডিআই পাই সেটা কমে গেছে। আমাদের প্রচলিত রেমিটেন্সের বাইরে যে ডলারের প্রবাহ হতে পারে সেটা কমে গেছে। এই জায়গাগুলোতে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। স্থিতিশীল এক্সচেঞ্জ রেট নিশ্চিত করতে পারলে একটা ভরসার পরিবেশ আমরা নিশ্চয়ই তৈরি করতে পারি। গত ১৫ বছরে অর্থনীতি এতো ভালো করার একটা বড় কারণ হলো রাজনীতিটা স্থিতিশীল ছিলো। এখন সেই স্থিতিশীলতটা রক্ষা করতে চেষ্টা করতে হবে। নির্বাচনের বছরে অর্থনীতি খানিকটা অস্থিতিশীল হয়। কিন্তু আশা করবো নির্বাচনের পর একটি স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসবে। তখন অর্থনীতিও খানিকটা দম নেওয়ার সুযোগ পায়। আর আর্থিক খাতে প্রোয়জনীয় সংস্কারের যে কোনো বিকল্প নেই, সেই কথাটি তিনি নীতিনির্ধারকদের অনুধাবন করতে হবে।
[৭] টাকার মান এতোটা কমলো কেন?
ড. আতিউর রহমান: টাকার মান কমে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের নিঃসন্দেহে। তবে এটিই আসলে বাস্তবতা। আমাদের দেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়েছে তার পেছনে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাই মূলত দায়ী। একথা ঠিক যেই পরিমাণ আমদানি আমাদের করতে হচ্ছে রেমিটেন্স ও এক্সপোর্ট আয় দিয়ে সেটা আমরা পূরণ করতে পারছি না। সে কারণে কোথাও না কোথাও থেকে আমাদের এটা মেটাতে হচ্ছে। সেজন্যই রিজার্ভের ওপর হাত পড়েছে। একথা ঠিক যে এ কারণেই রিজার্ভ কমছে। গত মাসেই, বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসে আমরা লক্ষ্য করলাম, আইএমএফ-এর প্রোগ্রামের কারণে ও এডিবি থেকে বৈদেশিক অর্থ আসার কারণে রিজার্ভ খানিকটা বাড়ছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। রিজার্ভ বাড়িয়ে যেতে হবে। একইসঙ্গে বড় বড় আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোকে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে উৎসাহী করতে হবে। নিরন্তর রিজার্ভ থেকে তাদের সহায়তা দিলে কোনোদিনই আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজার চাঙ্গা হবে না। আমার মনে হয় রিজার্ভ নিয়ে যতোটা আতঙ্ক ছড়ানো হয় সমস্যাটা অতোটা না। কারণ ৩ মাসের বেশি আমদানি করার মতো ডলার এখনো আমাদের হাতে আছে। আর রিজার্ভ তো চলমান একটি সূচক। আগামী বছরে নিশ্চয়ই রেমিট্যান্স, এক্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে না। অন্যদিকে আমদানি কমানোর একটা চেষ্টাও চলছে। তাই আমার ধারণা আগামীতে রিজার্ভ বেশ খানিকটা বাড়বে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাটা জরুরি। তখন আর এটা সঙ্কট মনে হবে না। বিনিময় হারে যেটা এডজাস্টমেন্ট হয়েছে সেটা বাজারের চাহিদা মতোই হয়েছে। তবে পুরোটা বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য ঘাটতি দেখা দিলে এমনটি তো হবারই কথা। এমন না যে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছে করে তা করেছে। এটা ভালো হতো যদি আরও আগে করা যেতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা করতে পেরেছে এবং আমার মনে হয় আগামীতে এটা আরও বাজার নির্ভর করতে তারা উৎসাহ দেখাবে।
[৮] নমনীয় একটা এক্সচেঞ্জ রেট নিশ্চয় আগামীতে চালু থাকবে। খালি এক্সচেঞ্জ রেট নমনীয় হলেই কিন্তু চলে না। এর সঙ্গে সঙ্গে রেট অব ইন্টারেস্টও নমনীয় রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সেদিকেই যাচ্ছে। একদিকে এক্সচেঞ্জ রেট নমনীয় রাখার চেষ্টা করছে অন্যদিকে রেট অব ইন্টারেস্টও নমনীয় করার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে তারা পরিবর্তনটা আনছে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনও আছে। কারণ খুব জোরে গাড়ি চালালে এক্সিডেন্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। সেদিক বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ব্যাংক এগোচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে করার ঝুঁকিও আছে। গুজব বেড়ে যায়। মানুষ তখন ডলার হাত ছাড়া করতে চান না। রপ্তানিকারকেরাও পুরো বিদেশি আয় দেশে আনতে চান না। তা সত্ত্বেও আমরা আশা করবো বাংলাদেশ ব্যাংককে যেন আমরা সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আসল সমস্যা হলো রাজস্ব পলিসি। সবসময় মনিটরি পলিসির সঙ্গে এটি সমন্বিত হয়না। যেমন এই মুহূর্তে আমরা দেখলাম বেশকিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয় না। সরকার যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না তখন টাকা ছাপতে হয় না। আর টাকা যদি না ছাপানো হয় তাহলে মূল্যস্ফীতির উপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১ টাকা সরকারি ঋণ নেওয়া মানেই বাজারে এটা ৪-৫ টাকা হয়ে যায়। এটি খুবই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টাকা। এটাকে বলে রিজার্ভ মানি। যে টাকাটা বাজারে দ্রুত ঘুরতে থাকে। এটা বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিলো। সম্প্রতি বছর শেষে এসে দেখতে পাচ্ছি আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের খানিকটা হলেও ঋণ নেওয়া শুরু হয়েছে। কারণ হয়তো রেভিনিউ সেই পরিমাণে সংগ্রহিত হয়নি। অথবা হয়তো কোনো কোনো জায়গায় খরচের কমিটমেন্ট করা আছে। সেজন্য সরকার আবার ঋণ নিচ্ছে। আবার ঋণ নেওয়া মানেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার যে উদ্যোগগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে সেটার ওপর চাপ পড়ছে। আমার মনে হয় এই জায়গাটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের মধ্যে আরও সমন্বয় গড়ে ওঠা দরকার। আরও বিচার বিশ্লেষণের দরকার।
[৯] মেগা প্রকল্পগুলোর প্রভাব জিডিপিতে কতোটা পড়তে শুরু করেছে?
ড. আতিউর রহমান: পদ্মা সেতুর কারণে পুরো ২১টি জেলার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে। অন্যদিকে মেট্রোরেলের কারণে ঢাকা শহরের ভেতর যোগাযোগ বেড়েছে। যখন পুরো দিনের জন্য মেট্রোরেল চালু করা হবে তখন আরও অনেক লোক আসা-যাওয়া করতে পারবে। সারাদেশের উত্তর-পূর্ব-দক্ষিণ-পশ্চিম সব রাস্তার কানেকশন বেড়ে গেছে। এই সব ব্রিজগুলোর কারণে একদিনেই সারা বাংলাদেশকে কানেক্ট করা যায় যেকোনো জায়গা থেকে। এই কানেক্টিভিটির একটা ইতিবাচক অর্থনীতির প্রভাব তো পড়ছেই। এই বড় প্রকল্পগুলো হওয়ায় কানেক্টিভিটি আরও বাড়ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় বিমান বন্দরে এখন অতি স্বল্প সময়ে যাওয়া যায়। দিল্লিতে মেট্রোরেল হওয়ার কারণে দিল্লির জিডিপি ৯ শতাংশের মতো বেড়ে গিয়েছিলো। সুতরাং আমাদেরও তো এর প্রভাব পড়ছে। আমার ধারণা যতোগুলো মেগাপ্রজেক্ট (যেমন মেট্রোরেল, পদ্মা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল) চালু হয়েছে, সবগুলো মিলে ইতোমধ্যে এক থেকে দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি জিডিপিতে এর মধ্যে যোগ হওয়া শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় এই হার আরও বাড়বে। পরিবহন সম্পর্কিত যেসমস্ত সংযোগ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো একেবারে জিডিপির প্রবৃদ্ধির জন্য অন টার্গেট। ট্রান্সপোর্ট কানেক্টিভিটি বাড়লে জিনিসপত্র খুব দ্রুত চলাচল করতে পারে, সস্তাও হয়। এখন বরিশাল থেকে একটা পণ্যবাহী ট্রাক কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসছে। আগে এটা সম্ভব ছিলো না। আগে মাওয়া ঘাটে এসে ট্রাকগুলোকে বসে থাকতে হতো। পণ্যগুলো পঁচে যেতো। তবে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার কথা মাথায় রেখে পরবর্তী সময়ে যেকোনো বড় প্রজেক্টে হাত দিতে হবে। আমরা কথায় কথায় বড় বড় প্রজেক্ট নিচ্ছি, অথচ পর্যাপ্ত রেভিনিউ অর্জন করতে পারছি না, কিংবা বিদেশ থেকে লোনেরও সমাবেশ ঘাঁতে পারছি না এমনটি কাম্য নয়। তাই এই পরিস্তিতিতে আমাদের আরও সাবধান হতে হবে। তবে আমরা অনেকগুলো বড় প্রকল্প শেষ করে এনেছি বা আনছি। তাই এখন একটু ধীরে গেলে ক্ষতি নেই।
[১০] আইএমএফ কিন্তু বলেছে যে, তাদের কর্মসূচি চলাকালে মাত্র ৫টি বড় প্রকল্প আমরা হাতে নিতে পারবো। এরকম একটি রূপরেখা তারা দিয়েছে। এটা আইএমএফ দেবে কেন আমরাও বুঝতে পারি না। হতে পারে আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে এই বার্তাটি তারা দিতে চাইছে। সেজন্য আমাদের রেভিনিউ মবিলাইজেশনের দিকে আরও নজর দিতে হবে। রেভিনিউ যতো বেশি সমাবেশ করবো, এক্সচেঞ্জ রেট স্ট্যাবিলাইজ করার পরে যদি রেমিটেন্সও বাড়তে থাকে তখন আরও বড় প্রকল্প আমরা নিশ্চয়ই নিতে পারবো। কয়টা প্রকল্প নেবো, কখন নেবো সেটা নির্ভর করবে আমাদের ম্যাক্রো অর্থনীতির অবস্থার ওপর। এসব বিষয় মাথায় রেখে আমাদের পলিসি নিতে হবে। হুটহাট করে যেকোনো একটা পলিসি নিলে চলবে না। লংটার্ম চিন্তা করতে হবে। আমাদের আজকের যে সমস্যা সেটা একদিনে তৈরি হয়নি। তাই এর জন্য মডেলিংয়ের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রজেকশন দরকার। আরও গবেষণা দরকার। আমাদের নীতি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত দরকার। তারা আলোচনা করবেন আগামী ৫ বছরে আমরা কতো আয় করবো, কতো ব্যয় হবে, কতো ব্যয় হওয়া উচিত এসব বিষয় নিয়ে। সর্বক্ষণ এর একটা বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে তরুণ গবেষকরা এই কাজ করতে খুবই পারদর্শী। তাদের দরকার নীতিগত কিছু নির্দশনা ও নেতৃত্ব দেওয়া। আমার মনে হয় সঠিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারলে এই ছেলেমেয়েগুলোই চমৎকার সব প্রজেকশন করবে এবং বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য যা যা করা দরকার তারা তার দিক-নির্দেশনা দিতে পারবে। তারা ইতোমধ্যে তা দেওয়া শুরুও করেছে। তাদের সঙ্গে কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত যুক্ত করলেই বিষয়টি আমাদের জন্য ভালো হবে। আর আইএমএফ কর্মসূচি থাকায় আন্তর্জাতিক কারিগরি সহযোগিতা তো পেতেই পারি। শ্রুতিলিখন: জান্নাতুল ফেরদৌস
আপনার মতামত লিখুন :