শিরোনাম

প্রকাশিত : ২১ জুন, ২০২৩, ১১:১৭ দুপুর
আপডেট : ২১ জুন, ২০২৩, ১১:১৭ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বর্ষার অর্থনীতিতে প্রান্তিক মানুষের জীবিকা নিয়ে রাষ্ট্রের নতুন করে ভাবা দরকার: ড. সেলিম জাহান

ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] ড. সেলিম জাহান- দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (আমেরিকা) একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র । এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘অর্থনীতি-কড়চা’, ‘Freedom for Choice’ প্রভৃতি।

[৩] দেশের এই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ কথা বলেছেন বর্ষার অর্থনীতি নিয়ে। বর্ষাকালের অর্থনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক কী, কীভাবে ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা রাখা যায়, নেতিবাচক অর্থনৈতিক দিকগুলোকে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে এনে কী করে অর্থবহ করে তোলা যায়; একইসঙ্গে নগরের অর্থনীতির ইতিবাচক-নেতিবাচক নিয়েও কথা বলেছেন আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে। 

[৪] আমাদের অর্থনীতি: বর্ষার অর্থনীতি নিয়ে খুব কথা হয়। অথচ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্ষার অর্থনীতির অর্থনীতির ইতিবাচক দিকগুলো আপনার বিবেচনায়, বলবেন কী?

ড. সেলিম জাহান: বাংলাদেশের অর্থনীতি মৌসুমী অর্থনীতি। বাংলাদেশের সার্বিক কার্যক্রম, বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের মানবজীবনÑসবগুলোই মৌসুমের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের নির্ধারিত মৌসুম আছে। যেমন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্ত ইত্যাদি। এখন বর্ষার অর্থনীতিতে যদি আসি, তাহলে মনে রাখতে হবে যে বর্ষার অর্থনীতির একটা ইতিবাচক দিক আছে। নেতিবাচক দিকও একটি আছে। 

[৫] বর্ষার অর্থনীতির ইতিবাচক দিক কী? বর্ষার অর্থনীতির ইতিবাচক দিক হচ্ছে- আমাদের অর্থনীতি হচ্ছে কৃষিনির্ভর। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে বর্ষার জলের একটা বিরাট প্রভাব আছে। গ্রীষ্মের পর যদি বর্ষার জল না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের আঊস ও বেরো ধানের ফলন ভালো পাবো না। ফলে বর্ষার জল আমাদের অর্থনীতিতে কৃষির মাধ্যমে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

[৬] লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বর্ষার মৌসুমে বিভিন্ন জায়গায় প্লাবন হয়। প্লাবনের অবশ্যই একটা নেতিবাচক দিক আছে। কিন্তু একটা ইতিবাচক দিকও আছে। এই প্লাবনের ফলে পলি-মাটি জমে। পলি-মাটিগুলো আমাদের ক্ষেত-খামার, ধানের জমি, চাষের জমিতে জমা হয়। এতে আমাদের জমির উর্বরতা শক্তি বেড়ে যায়। 

[৭] গ্রীষ্মের খরার পরে যখন বর্ষা আসে, সেটা পরিবেশের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভা ফেলতে পারে। পরিবেশ, গাছ-পালা এবং আমাদের যে সমস্ত বনজসম্পদ আছে, সেগুলো বেড়ে উঠতে বর্ষার জল সাহায্য করে। এসবই ইতিবাচক দিক।

[৮] বর্ষাকালের অর্থনীতির নেতিবাচক দিকগুলো কী? 

ড. সেলিম জাহান: বর্ষাকালে মানুষের কর্মনিয়োজন খুব সীমিত হয়ে যায়। বিশেষত যারা দিনমজুর, যারা দিনে এনে দিন খান- তাদের কাজের সীমাবদ্ধতা অনেক বেড়ে যায়। তারা কাজ পান না। তারা অর্থকড়ি কাজ পান না। তারা কাজে নিয়োজিত হতে পারেন না। এর ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের আয় নেই। খাদ্যের অভাব হয়। এটা বর্ষার অর্থনীতির একটা নেতিবাচক দিক। 

[৯] বর্ষা অর্থনীতিতে খাদ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের। কারণ স্বাভাবিকভাবে যদি কর্মে নিয়োজিত না থাকে, আয় না থাকে, তাহলে তারা খাবার কিনবেন কোথা থেকে? সেজন্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ বর্ষার সময় মিষ্টি কুমড়ো, চাল-কুমড়োর মতো জিনিসের ওপর নির্ভর করে হয়তো দিন বা সপ্তাহের খাবার যোগাড় করেন বা কিনেন। 

[১০] একইসঙ্গে যে সমস্ত জায়গায় কাঠাল ফলে, এটা হয়তো আমাদের শহরের মানুষদের অনেকেই জানি না, বর্ষাকালে দরিদ্র মানুষের খাদ্যের অন্যতম উৎস কাঠাল। এই যে খাদ্যের নিরাপত্তার একটা অভাব, এটা বর্ষাকালে আমাদের যাপিতজীবনে দেখা দেয়। 

[১১] বর্ষার সময় যে সমস্ত জলবাহিত অসুখ আছে, সেগুলো ছড়ায়। উদারময়ের কথা আমরা সকলেই জানি। এর বাইরেও বর্ষার জলবাহিত যে সমস্ত অসুস্থতা হতে পারে, সেটা গ্রামে-গঞ্জে, সেটা আমাদের শহরেও দেখতে পাই। 

[১২] বর্ষায় নগরজীবনের সুবিধা-অসুবিধা কী বলে মনে করেন আপনি?

ড. সেলিম জাহান: বর্ষার সময়ে নগরজীবনে, বিশেষ করে ঢাকার কথা যদি বলি- তাহলে দেখা যাবে যে যানজটের কারণে যাতায়াতে মানুষের অনেক ভোগান্তি হয়। সেটা হয়তো গরমকালে হলে হয়তো হেঁটে চলে যেতে পারে অথবা অন্য কোনোভাবে হয়তো তার কাজের জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু বর্ষার সময় শহরের মানুষেরা এই ভোগান্তিতে পড়ি। 

[১৩] বর্ষার অর্থনীতি নিয়ে যখন আমরা কথা বলবো তখন নিশ্চিতভাবেই নগর অর্থনীতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির মধ্যে একটা প্রার্থক্য থাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু কিছু দিক নিয়ে বলেছি। নগর অর্থনীতির একটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে- বর্ষার নানন্দিক সুভাস আমরা পাই। উপভোগ করি। বর্ষার গ্রীষ্মের পরে নগরের মানুষদের জন্য একটা স্বস্তি এনে দেয়। ফলে বর্ষার সময় বর্ষা দেখা, বৃষ্টিতে ভেজা, অন্যান্য কাজগুলো করতে গিয়ে বেশ উপভোগই করি। বর্ষার সময় ইলিশ খিচুরি ব্যবস্থা করা, সেটাও নগর জীবনের একটা ইতিবাচক দিক। 

[১৪] বর্ষাকালে নগর জীবনের নেতিবাচক দিক হচ্ছে- শুধু নানন্দিক ব্যবস্থার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, সেখানে কাজ করতে হবে। কাজের জায়গা যেতে হবে। যানবাহনের সমস্যা তৈরি হয়, বিশেষ করে বর্ষার সময় সেটা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ কোন যানবাহনে আমি যাবো, সেই যানবাহনে ঢুকবো কিনা, সেটার যেমন একটা দিক আছে, তেমনি যানবাহনের খরচও বেড়ে যায়। যেমন রিকশা বা স্কুটারের ভাড়া অনেক বেশি বেড়ে যায়। জনজীবনে একটা ভোগান্তি তৈরি হয়। 

[১৫] নগরজীবনে প্রায়শ্চই দেখা যায় যে, বর্ষার জলপ্লাবিত হয়ে যাচ্ছে রাস্তার অলি-গলি। তখন শিশুদের বিদ্যালয়ে যেতে কষ্ট হয়। কর্মজীবীদের কর্মের জায়গা যেতে কষ্ট হয়। এই জলপ্লাবন, নগরের নিষ্কারশন ব্যবস্থার যে উন্নতি হয়নি, নিষ্কাশন ব্যবস্থায় একধরনের গলদ আছে, তার কারণে নগর জীবন পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। 

[১৬] বর্ষার অর্থনীতিতে গ্রামীণ প্রান্তিক কৃষকেরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতেন আগে, এখন সেই জায়গায় পরিবর্তন দেখেন কিনা। বর্ষায় কর্মহীন মানুষদের জন্য প্রশাসনিক বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কী যথেষ্ট বলে মনে করেন?

ড. সেলিম জাহান: বর্ষায় গ্রামের কৃষকদের ভোগান্তি অনেক হতো, কিন্তু কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্র সেখানে অন্য রকমের কর্ম নিয়োজনের একটা ব্যবস্থা করেছে। কুটির শিল্পের ব্যবস্থা আছে। ঘরে বসে কাজ করার ব্যবস্থাও করেছে। পণ্য তৈরি, বিপণন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি বেশ কাজে দিচ্ছে। এখন আমরা প্রত্যেকেই মুঠোফোন ব্যবহার করি। কৃষকের কাছেও এখন মুঠোফোন আছে। এই মুঠোফোন ব্যবহার করে তারা নিজেদের তৈরি পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থা করে থাকেন। উপকরণের দিক থেকেও প্রশাসন সহযোগিতা করে থাকে। কুটির শিল্প যারা করেন তাদের কাছে কুটির শিল্প উপকরণ পৌঁছে দেওয়ার জন্যও রাষ্ট্র নানান ধরনের ব্যবস্থা করেছে। 

[১৭] দরিদ্র, কর্মহীন ও প্রান্তিক মানুষদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোন কোন উদ্যোগ নিলে বর্ষার অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে তারা নিজেদের পরিত্রাণ পাবে?

ড. সেলিম জাহান: বর্ষার অর্থনীতিতে গ্রামীণ কাজকর্ম অন্যভাবে নেওয়া যায় কিনা ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে, সেটা দেখতে হবে। ধানের ক্ষেত্রে তো প্রশাসন কাজ করেই থাকে। দিনমজুরের বর্ষায় কর্মহীন হয়ে পড়েন, তাদের জন্য একটা বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে হবে। যেমন আমি কুটির শিল্পের ব্যবস্থাগুলো তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া দরকার। এতে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষগুলো স্তস্তি পাবেন। দারিদ্র তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। অন্তত খাবারের কষ্ট যাতে তারা কোনোভাবে না পান- সেটা প্রশাসনকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। 

[১৮] বর্ষার অর্থনীতির একটা ইতিবাচক যেমন আছে, নেতিবাচক দিকও আছে। যেটা করণীয় সেটা হলোÑবর্ষার ইতিবাচক দিকগুলো আরও উৎসাহিত করা উচিত। আর নেতিবাচক দিকগুলো যতোটা সম্ভব ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি, সে ব্যাপারে আমাদের বেশি বেশি করে কাজ করতে হবে। সেটা ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্র- সবার মিলিত চেষ্টা থাকলে নেতিবাচক দিকগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব। 

[১৯] দরিদ্র বা দিনমজুর মানুষদের যদি আমরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, ঘরে বসেই যদি তারা কিছু করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন চাঁটাই বোনা, ঝুড়ি তৈরি করার মতো কাজে নিয়োজিত করা গেলে হয়তো তাদের ভোগান্তি বা কষ্ট অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। বর্ষার জলে জমি ঊর্বর হয়, বর্ষাকালে দরিদ্র মানুষ কর্মহীন হয়, বর্ষা নগরজীবনে স্বস্তি দেয়, বর্ষা নগরজীবনে ভোগান্তিও বাড়ায়, বর্ষার অর্থনীতিতে প্রান্তিক মানুষদের জীবিকা নিয়েও রাষ্ট্রের নতুন করে ভাববার দরকার আছে। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়